বুধবার   ২৯ অক্টোবর ২০২৫   কার্তিক ১৪ ১৪৩২   ০৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
৩৫

আস্থাহীন গণতন্ত্র, বিভাজন ও ডলার সংকট: যুক্তরাষ্ট্রের নীরব পতন

রাফিউল ইসলাম তালুকদার

প্রকাশিত: ২৯ অক্টোবর ২০২৫  

একসময় আমেরিকাকে বলা হতো আধুনিক গণতন্ত্রের মানদণ্ড। কিন্তু আজ সেই দেশেই প্রশ্ন উঠছে , এই ব্যবস্থার ভিত কি আগের মতোই দৃঢ় আছে? ধীরে ধীরে কি যুক্তরাষ্ট্রও এমন এক পথে হাঁটছে, যেখান থেকে ফেরার পথ কঠিন হয়ে যায়?

 

দীর্ঘ একটা সময় একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে দেশের নেতা হিসেবে দেখা হতো, কোনো দলের প্রতিনিধি হিসেবে নয়। কিন্তু গত দুই দশকে সেই চিত্র বদলে গেছে। বর্তমান রাজনীতিতে প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি বিবৃতি একদলকে তুষ্ট করার জন্য, অপর দলকে আঘাত করার জন্য। রাজনীতি এখন যুক্তির নয়, আবেগের খেলায় পরিণত হয়েছে। যেখানে জন ক্যানেডি বা রোনাল্ড রিগ্যান একে অপরের রাজনৈতিক মতবিরোধ সত্ত্বেও ‘যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ’কে অগ্রাধিকার দিতেন, আজ সেখানে প্রাধান্য পাচ্ছে ব্যক্তিগত ও দলীয় এজেন্ডা।

 

যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান কংগ্রেসকে কেন্দ্রীয় ভূমিকা দিয়েছে, যাতে নির্বাহী ক্ষমতা কখনো এককভাবে কারও হাতে না থাকে। কিন্তু বাস্তবে এখন দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতা ক্রমেই হোয়াইট হাউসের ভেতরে সরে যাচ্ছে। এই প্রবণতা লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মতো এক ধরনের “শক্তিশালী নির্বাহী ক্ষমতা, দুর্বল আইনসভা” সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে, যেখানে প্রেসিডেন্ট হয়ে উঠছেন রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু, আর পার্লামেন্ট হয়ে উঠছে  প্রতীকী শক্তি। যার ফলে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই বিশ্বাস হারিয়েছে রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি। “ভোট দিলে কী হয়?”, “মার্চ করেও কিছু বদলায় না” এমন হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ জনগণ। প্রতিবাদ, আন্দোলন, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট এগুলো এখন সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নয়, বরং দেখানোর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে জন্ম নিচ্ছে এক ধরনের নীরব আত্মসমর্পণ, যা গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।

 

ধনীদের পলায়ন ও আস্থার সংকট

যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার লড়াই এখন মূলত কৌশলের লড়াই। রক্ষণশীল রাজনীতি গত কয়েক দশকে আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তি তৈরি করেছে। বিপরীতে উদারপন্থীরা প্রায়শই প্রতিক্রিয়াশীল ও স্বল্পমেয়াদি আন্দোলনে সীমাবদ্ধ থেকেছে। ফলাফল, নীতি নয়, ক্ষমতা নির্ধারণ করছে কে ভালোভাবে “গেমটা খেলতে” পারে। এর ফলে প্রকাশ পাচ্ছে এক উদ্বেগজনক দিক, ক্রমবর্ধমান সংখ্যক ধনী আমেরিকান নাগরিক তাদের অর্থ ও বিনিয়োগ বিদেশে সরিয়ে নিচ্ছে, কেউ কেউ দ্বিতীয় নাগরিকত্ব নিচ্ছে। এটা শুধু কর এড়ানোর কৌশল নয়; এটি দেশের ভবিষ্যতের প্রতি অনাস্থার প্রকাশ। রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা হারালে প্রথমে চলে যায় অর্থ, তারপর মেধা, শেষমেশ ভেঙে পড়ে ভিত্তি। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ ভেনিজুয়েলা। দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির পতন একদিনে হয়নি। রাজনৈতিক মেরুকরণ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, স্বৈরাচারী শাসন, তারপর জনমুখী নীতি দিয়ে জনগণকে আশ্বাস, সব মিলিয়ে দেশটি ধীরে ধীরে দেউলিয়া হয়ে পড়ে। মজার বিষয়, প্রতিটি ধাপেই জনগণ ভেবেছিল “এটা সাময়িক, ঠিক হয়ে যাবে।”

আজ আমেরিকাতেও সেই একই আশ্বাস শোনা যায়। কিন্তু ইতিহাস বলে, পতন কখনো এক ঝটকায় আসে না, আসে ধীরে ধীরে, চোখের সামনেই।

 

ডলার সংকট ও বৈশ্বিক আস্থাহীনতা

অন্যান্য দেশের সম্পদ জব্দ করা কিংবা অতিমাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে অনেক দেশ এখন মার্কিন ডলারের ওপর আস্থা হারাচ্ছে। বৈশ্বিক বাণিজ্য ক্রমাগত ইউয়ান, রুবল বা ইউরোর দিকে হচ্ছে। এই প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদে ডলারের আধিপত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। যা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক শক্তির মূল স্তম্ভ।

 

রাজনৈতিক প্রভাব ক্রমে বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানেও ছড়িয়ে পড়ছে। শিক্ষাকে যখন দলীয় রাজনীতির চোখে দেখা হয়, তখন মেধাবীরা দেশ ছাড়তে শুরু করে। এই “ব্রেইন ড্রেইন” হচ্ছে এমন এক ক্ষতি, যা চোখে দেখা যায় না কিন্তু প্রজন্ম ধরে প্রভাব ফেলে।

 

দেশটির নাগরিকেরা বলছেন, এখনই সময় দেশ ছাড়ার বা বিকল্প নাগরিকত্বের কথা ভাবার। কেউ কেউ মনে করেন, পালানোর জন্য নয়, বরং বিকল্প নিশ্চিত করার জন্য এই সিদ্ধান্ত দরকার। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র একসময় ছিল আশ্রয়ের দেশ, এখন সেদেশের জনগণই খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে স্থিতিশীলতা আর আস্থা।

আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ নতুন নয়। কিন্তু আজকের সংকট ভিন্ন। এটি শুধু রাজনীতি বা অর্থনীতির নয়, বিশ্বাসের সংকট। যদি এই বিশ্বাস তলানিতে গিয়ে ঠেকে তাহলে সংবিধান, স্বাধীনতা বা প্রাতিষ্ঠানিক শৃংঙ্খলা  কিছুই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতার দেশটির পতন রুখতে পারবে না।

এই বিভাগের আরো খবর