মঙ্গলবার   ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫   আশ্বিন ৭ ১৪৩২   ৩০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
৩৩

এনসিপি-গণঅধিকার দরকষাকষি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫  

দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে তরুণদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠনের আগে থেকেই গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে একীভূত হয়ে নতুন দল গঠনের আলোচনা ছিল। এ নিয়ে দল দুটির শীর্ষ পর্যায়ে একাধিক বৈঠকও হয়। তবে সেখানে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের অবস্থান কী হবে—এই প্রশ্ন ঘিরে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় বিষয়টি তখন আর সামনে এগোয়নি। সম্প্রতি পুরোনো সেই আলোচনার পালে নতুন করে হাওয়া লেগেছে। যদিও গণঅধিকার-এনসিপি সংশ্লিষ্টদের মতে, এ একীভূত প্রক্রিয়া জটিল এবং দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। এখানে অনেক ‘যদি-কিন্তু’ জড়িয়ে আছে। উল্লেখযোগ্য ছাড় ও সমঝোতা ছাড়া একীভূত হওয়া কঠিন বলেই মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে, সম্ভাব্য এ একীভূতকরণে যুক্ত হতে পারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকা আরেকটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ইউনাইটেড পিপল অব বাংলাদেশও (আপ বাংলাদেশ)। বিশ্লেষকরা বলছেন, তরুণদের একীভূত হওয়ার এ প্রক্রিয়া সফল হলে তা দেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।

এনসিপি এবং গণঅধিকার পরিষদ মূলত একই প্রেক্ষাপট থেকে উঠে আসা দুটি শক্তি। দুদলই জন্ম নিয়েছে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বাধীন কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে। যেখানে সমান অধিকার, বৈষম্যহীন সমাজ এবং রাজনৈতিক স্বচ্ছতার প্রশ্ন সামনে আসে। আন্দোলন থেকেই সংগঠিত হওয়ার কারণে তাদের আদর্শিক ভিত্তি প্রায় একই। এ ছাড়া উভয় সংগঠনই রাজনৈতিক মূলধারায় নতুন বিকল্প শক্তি হয়ে উঠতে চায়। তাদের আন্দোলনের ইতিহাস, দাবি ও লক্ষ্য এক হওয়ায় যৌথভাবে কাজ করলে রাজনৈতিক পরিসরে প্রভাব আরও বাড়তে পারে। তাই রাজনৈতিক স্বার্থ, ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা এবং আদর্শিক মিলই তাদের একত্র হওয়ার যৌক্তিকতা তৈরি করছে।

তরুণদের একীভূত হওয়ার এ প্রচেষ্টাকে ইতিবাচক বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, একীভূত হওয়ার এ প্রক্রিয়া সফল হলে তা দেশের রাজনীতি বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আইনুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী তরুণ নেতৃত্ব গড়ে ওঠার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। তরুণদের শক্তিগুলো একীভূত হলে এটি তাদের জন্য ভালো। তারা যদি রাজনৈতিকভাবে গুছিয়ে উঠতে পারে, আদর্শ ঠিক করতে পারে, তাহলে দেশের রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারবে। আমি তাদের ভবিষ্যৎ ভালো দেখছি। আগামী নির্বাচন ও জাতীয় রাজনীতিতে তারুণ্যের জয়ের সম্ভাবনা ব্যাপক। আমরা যাদের প্রথম সারির বলে থাকি তাদের বাইরে তৃতীয় সারির রাজনৈতিক শক্তি যদি প্রথম সারিতে চলে আসে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।’

এনসিপি এবং গণঅধিকার পরিষদ নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাঠিপেটায় আহত হওয়ার পর নুরুল হক নুর হাসপাতালে ভর্তি হলে একীভূত হওয়ার আলোচনা নতুনভাবে গতি পায়। সে সময় থেকে গতকাল রোববার পর্যন্ত দুদলের নির্বাহী কমিটি পর্যায়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে। যদিও এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিশেষ করে দলের নাম কী হবে, নতুন দল গঠিত হবে কি না, নেতৃত্বের কাঠামো কীভাবে সাজানো হবে এবং নুরুল হক নুরের অবস্থান কী হবে—এসব বিষয় নিয়ে নানা প্রস্তাব আলোচনার টেবিলে আছে। এসব ইস্যুর সুরাহা হলে আলোচনা চূড়ান্ত রূপ পেতে পারে।

দল দুটির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা কালবেলাকে নিশ্চিত করেছেন, একীভূত হলে দলের নতুন নাম গঠনের সম্ভাবনা আপাতত কম। বরং ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)’ নামেই থাকার আলোচনা বেশ এগিয়েছে। নেতৃত্বের প্রশ্নে এনসিপির প্রস্তাব—নাহিদ ইসলামকে প্রধান রেখে নুরুল হক নুরকে সম্মানজনক পদে রাখা। তবে গণঅধিকার পরিষদ চাইছে, নতুন কমিটি গঠন করে নাহিদ ইসলাম ও নুরুল হক নুর উভয়কেই দলের প্রধান হিসেবে রাখা। সে লক্ষ্যে সভাপতি ও নির্বাহী সভাপতির—দুটি পদ সৃষ্টির প্রস্তাবও উঠেছে।

নেতারা আরও জানান, এনসিপি এবং গণঅধিকার একীভূত হওয়ার চিন্তার পেছনে অন্যতম কারণ আগামী নির্বাচন। একসঙ্গে থাকলে নির্বাচনের মাঠে শক্তিশালী বার্তা দেওয়া যাবে। এ ছাড়া তপশিল যদি দ্রুত ঘোষণা হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে এনসিপির নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ হবে না। তাতে গণঅধিকারের ব্যানারেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। এমনটি হলে গণঅধিকার নামকেই বেছে নিতে হতে পারে।

এনসিপির নির্বাহীর কমিটির এক সদস্য কালবেলাকে বলেন, আমরা একীভূত হতে আন্তরিক। তবে সেটি এনসিপি বিলুপ্ত করে নয়। আমাদের সাংগঠনিক কাঠামো ঠিক রেখে নুরুল হক নুরকে সম্মানজনক পদে রেখে আমরা এগোতে চাই। অন্যান্য শীর্ষ পদেও গণঅধিকার পরিষদের কয়েকজনকে যুক্ত করা হতে পারে।’

গণঅধিকার পরিষদের শীর্ষ এক নেতা জানান, একীভূত হওয়ার পথে নেতৃত্ব বড় প্রশ্ন। ডাকসুর সাবেক ভিপি ও গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি হিসেবে নুরুল হক নুরকে অবশ্যই শীর্ষ পদে দেখতে চান দলটির নেতাকর্মীরা। অথবা নতুন কমিটি গঠন করে নুর এবং নাহিদ ইসলাম দুজনকেই প্রধান হিসেবে রাখা যায়। সেক্ষেত্রে একজন সংগঠন এবং আরেকজন রাজনীতির বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে দেখবেন। অন্যান্য পদও রাজনৈতিক দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে চূড়ান্ত হতে পারে।

এ নিয়ে গণঅধিকার পরিষদের তৃণমূলের কর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বেশিরভাগই নাম পরিবর্তনের বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন। আবার কেউ কেউ নুরকে প্রধান করার শর্তে বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। কিংবা নুরুল হক নুরকে সভাপতি ও নাহিদ ইসলামকে সাধারণ সম্পাদক করে নতুন কমিটি গঠনের পক্ষেও মত তাদের। তবে দল দুটির অনেক নেতাকর্মী মনে করেন এই প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হওয়া উচিত ছিল অন্তত এক বছর আগে, তাহলে দেশের রাজনীতিতে অনেক বেশি শক্তিশালী অবস্থানে থাকত দলটি। তরুণদের দুই শক্তি একীভূত হলে এখনো দারুণ সম্ভাবনা দেখছেন তারা। এনসিপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও একীভূত হওয়ার পক্ষে, তবে তারা নাহিদ ইসলামকেই শীর্ষ নেতা হিসেবে দেখতে চান।

দলটির উচ্চতর পরিষদের সদস্য আবু হানিফ বলেন, ‘আমাদের দুই দলের মধ্যে একাধিকবার এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা বিষয়টিতে সবাই পজিটিভ। কিছু বিষয়ের সুরাহা হলে এটি চূড়ান্ত হতে পারে। নুরুল হক নুর উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন। তিনি চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরলে এ আলোচনা আরও এগোবে।’

বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের মানুষ রাজনীতিতে তরুণ নেতৃত্ব দেখতে চায় বলে মনে করেন গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক শাকিল উজ্জামান। তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে তরুণরা তাদের সম্ভাবনা প্রমাণ করেছে। ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে ভূমিকা রাখা তরুণরা ঐক্যবদ্ধ হলে দেশের মানুষ আস্থা অর্জনের মতো একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম পাবে।’

একীভূত প্রক্রিয়ার অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ‘একই আন্দোলন কেন্দ্র করে গড়ে উঠা, একসঙ্গে ডাকসু নির্বাচন করা, মোদিবিরোধী আন্দোলনসহ আদর্শিক মিল থাকায় সবাই চায় আমরা একসঙ্গে পথ চলি। আমরাও সে বিষয়ে আন্তরিক। নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে। একসঙ্গে হওয়ার আন্তরিকতা, উদারতার ওপর নির্ভর করছে এটির চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছানো। দলের নাম কিংবা নেতৃত্বের বিষয়ে এখনো আলোচনা চলমান আছে। প্রয়োজনে আমরা পাবলিক অপিনিয়ন (জনমত) নেব।’

একীভূত হতে ইতিবাচক এনসিপি নেতারাও। দলটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব কালবেলাকে বলেন, ‘তরুণদের প্রতি দেশের মানুষের আস্থা রয়েছে। তারা বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় আমাদের একসঙ্গে দেখতে চায়। এ নিয়ে দুই দলের নির্বাহী পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা সবাই এ বিষয়ে ইতিবাচক। কীভাবে একীভূত হবে, কোন প্রক্রিয়ায় হবে, এসব আলোচনা এখনো চলমান আছে।’

তরুণদের সব শক্তি এক হলে তা দেশের জন্য সুফল বয়ে আনবে বলে মনে করেন এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক স্বার্থে বাংলাদেশ এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে সামনে রেখে আমরা একসঙ্গে কাজ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব। আমি মনে করি এটি বাস্তব রূপ পেলে বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে।’

দলটির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, ‘গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে একীভূত হওয়ার আলোচনা চলছে, তা সত্য। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট, সেটি হলো এনসিপি বিলুপ্ত বা নাম পরিবর্তন হচ্ছে না। অন্য দু-একটা দলের সঙ্গেও আলোচনা চলছে। তরুণদের শক্তিগুলো ঐক্যবদ্ধ হলে রাজনীতিতে এক নতুন যুগের সূচনা হবে।’

এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদের বাইরে আপ বাংলাদেশও একীভূত হওয়ার আলোচনায় রয়েছে। এনসিপির সঙ্গে তাদের প্রাথমিক আলাপ আলোচনা হয়েছে বলেও জানা গেছে। কালবেলার প্রশ্নের জবাবে আপ বাংলাদেশের আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ বিষয়টি নিশ্চিতও করেছেন। তিনি বলেন, ‘একীভূত হওয়ার বিষয়ে প্রাথমিক আলাপ হয়েছে, তবে আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা এখনো এটি নিয়ে বসিনি এবং কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছিনি।’

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০১৮ সালের আন্দোলন থেকে নুরুল হক নুরের নেতৃত্বে উঠে আসে গণঅধিকার পরিষদ। ২০১৯ সালে ডাকসুতে জয়ী হওয়ার পর ২০২১ সালের অক্টোবরে দলটির আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটে। শুরুতে ড. রেজা কিবরিয়া আহ্বায়ক থাকলেও পরবর্তী সময়ে নুর সভাপতি ও রাশেদ খান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে দলটি নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায়।

অন্যদিকে, ২০২৪ সালের জুলাইয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সামনের সারিতে থাকা তরুণরা গঠন করেন এনসিপি। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে যাত্রা শুরু হওয়া এ দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্য সচিব আখতার হোসেন। বর্তমানে তাদের নিবন্ধন প্রক্রিয়াধীন। এর মধ্যে আখতার ২০১৯ ডাকসুতে নুরুল হক নুরের প্যানেল থেকে সমাজসেবা সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। দুজনই নুরুল হক নুরের গণঅধিকার পরিষদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র অধিকার পরিষদে যুক্ত ছিলেন। শুধু তাই নয়, এনসিপির অনেক নেতাই একসময় গণঅধিকার পরিষদ ও এর অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

একসময় গণঅধিকার পরিষদ রাজপথের আন্দোলন থেকে গড়ে ওঠা তরুণদের একমাত্র সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক দল ছিল। পরে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর যুক্ত হয় জাতীয় নাগরিক পার্টি। দুটি দলই তারুণ্যনির্ভর এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য থেকে গড়ে ওঠা। গত এক দশকে দেশের তরুণদের মধ্যে রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাও তৈরি করেছেন তারা একসঙ্গে। সবমিলিয়ে আদর্শিক মিল থাকাই তাদের মধ্যে এক হওয়ার আলোচনা চলছে।

এই বিভাগের আরো খবর