সোমবার   ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫   পৌষ ১ ১৪৩২   ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৭

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
১৫

আধুনিক চীনা স্বর্ণের ব্যবহার ও জাকাতের বিধান

তরুন কণ্ঠ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫  

স্বর্ণ মানব ইতিহাসে কেবল মূল্যবান ধাতু নয়, বরং এটি ইসলামি অর্থব্যবস্থায় মুদ্রা হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। সম্প্রতি চীনের প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের ফলে বাজারে নতুন ধরনের স্বর্ণ প্রবেশ করেছে, যাকে বলা হচ্ছে ‘আধুনিক চীনা স্বর্ণ’। তবে বাজারে এই স্বর্ণ ‘হার্ড পিউর গোল্ড’ নামে পরিচিত।


এই উদ্ভাবন স্বর্ণের ভৌত বৈশিষ্ট্যকে পাল্টে দিয়েছে। তাই শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে এর বিধান কী হবে, তা জানা জরুরি। আমরা প্রথমে পুরাতন চীনা স্বর্ণ এবং পরে আধুনিক চীনা স্বর্ণের সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য ও ফিকহি বিধান আলোচনা করব।


পুরাতন চীনা স্বর্ণের পরিচয় ও বিধান
‘চীনা স্বর্ণ’ শব্দটি পূর্বে বাজারে প্রচলিত এমন এক ধরনের নকল স্বর্ণকে নির্দেশ করত, যা দেখতে খাঁটি স্বর্ণের মতো হলেও আসলে এটি ছিল তাম্র (কপার) ও দস্তার (জিঙ্ক) মতো অন্যান্য ধাতুর সংকর, যার ওপর স্বর্ণের একটি পাতলা প্রলেপ দেওয়া হতো।


এর দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রথমতঃ এটি দ্রুত জারিত (oxidized) হয়ে যেত এবং ত্বকে কালচে দাগ সৃষ্টি করত। দ্বিতীয়তঃ খাঁটি স্বর্ণের মতো এর হলুদ ঔজ্জ্বল্য স্থায়ী হতো না, দ্রুত তা ম্লান হয়ে যেত।


পুরাতন চীনা স্বর্ণের বিধান
এই ধাতুকে নামে ‘স্বর্ণ’ বলা হলেও বাস্তবে এটি খাঁটি স্বর্ণ নয়। তাই ফিকহি দৃষ্টিকোণ থেকে এর ওপর স্বর্ণের বিধান প্রযোজ্য নয়। এই ধরনের স্বর্ণের ক্ষেত্রে প্রধানত ৩ ধরনের বিধান মনে রাখতে হবে।


১. পুরুষের জন্য ব্যবহার: এটি খাঁটি স্বর্ণ না হওয়ায় পুরুষদের জন্য এর আংটি বা এ জাতীয় অলংকার ব্যবহার করা বৈধ। কারণ, রাসুল (সা.) পুরুষদের জন্য কেবল খাঁটি স্বর্ণ ব্যবহার নিষেধ করেছেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৬৯৯)

যেহেতু আধুনিক চীনা স্বর্ণ ৯৯.৯% বিশুদ্ধ এবং এর বৈশিষ্ট্য বর্ধনের জন্য সামান্য যে সংকর যোগ করা হয়েছে, তা এর খাঁটি স্বর্ণ হওয়ার পরিচয় নষ্ট করেনি, তাই ফিকহি 
দৃষ্টিকোণ থেকে এটি সম্পূর্ণ খাঁটি স্বর্ণের বিধান লাভ করবে।


২। জাকাতের বিধান: পুরাতন চীনা স্বর্ণের পুরো ওজনের ওপর জাকাত প্রযোজ্য হয় না। এক্ষেত্রে তিনটি অবস্থা প্রযোজ্য:
প্রথম অবস্থা: এতে যে পরিমাণ খাঁটি স্বর্ণের প্রলেপ আছে, শুধু তার মূল্য হিসাব করা হবে। যদি শুধু সেই মূল্য জাকাতের নিসাব (৮৫ গ্রাম স্বর্ণের মূল্য) পরিমাণ হয়, তবে তার ওপর জাকাত দিতে হবে।


দ্বিতীয় অবস্থা: যদি প্রলেপের স্বর্ণের পরিমাণ নিসাব না হয়, তবে সেই পরিমাণকে ব্যক্তির মালিকানায় থাকা অন্য খাঁটি স্বর্ণের সঙ্গে যোগ করা হবে। যোগফল নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত আবশ্যক হবে।


তৃতীয় অবস্থা: যদি প্রলেপের স্বর্ণের পরিমাণ এবং অন্য স্বর্ণ যোগ করেও নিসাব পরিমাণ না হয়, তবে কোনো জাকাত দিতে হবে না।


৩. নগদ অর্থের ক্রয়-বিক্রয়ের বিধান: এর ওপর স্বর্ণ বা রৌপ্যের ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত বিশেষ বিধান (অর্থাৎ, সমান-সমান বিনিময়ের আবশ্যকতা) প্রযোজ্য হবে না। কারণ, এটিকে ফিকহের পরিভাষায় স্বর্ণ হিসেবে গণ্য করা হয় না, বরং এটি অন্যান্য পণ্যের মতোই সংকর ধাতু।


আধুনিক চীনা স্বর্ণের পরিচয়

২০২৪ সালের মে মাসে চীন একটি নতুন স্বর্ণের ঘোষণা দেয় এবং এর পেটেন্ট লাভ করে। ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে এটি বাজারে আসে। এই স্বর্ণকে ‘খাঁটি পরিশোধিত স্বর্ণ’ নামেও ডাকা হয়।


আধুনিক চীনা স্বর্ণ হলো খাঁটি স্বর্ণ। এটি ২৪ ক্যারেটের, যার বিশুদ্ধতার হার ৯৯.৯%। তবে এর বৈশিষ্ট্য উন্নত করার জন্য এতে ০.১% ইনডিয়াম ও দস্তার (জিঙ্ক) মতো দুষ্প্রাপ্য ধাতু মেশানো হয়। এই সামান্য মিশ্রণ এর ঔজ্জ্বল্য ও বিশুদ্ধতার ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না, বরং এর ভৌত গুণাবলিকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে তোলে।


আধুনিক চীনা স্বর্ণ চারটি বিশেষ গুণের অধিকারী, যা একে প্রচলিত স্বর্ণ থেকে আলাদা করে:

বিশুদ্ধতা: এতে ৯৯.৯% বিশুদ্ধ স্বর্ণ থাকে, যা ২৪ ক্যারেটের সমতুল্য।


কাঠিন্য: ভিকারস স্কেলে এর কাঠিন্য ৬০ ডিগ্রি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে, যা প্রচলিত স্বর্ণের চেয়ে প্রায় ছয় গুণ বেশি। এই দৃঢ়তা একে ১৮ ক্যারেট স্বর্ণের স্থায়িত্ব দেয়।


সহজে আকার দান: এর দৃঢ়তা সত্ত্বেও এটি সহজেই বিভিন্ন জটিল নকশার গহনা তৈরিতে উপযোগী, যার ফলে অপেক্ষাকৃত কম ওজনের গহনা তৈরি সম্ভব হয়।

ক্ষয়রোধ ক্ষমতা: এটি প্রচলিত স্বর্ণের চেয়ে বেশি ক্ষয়রোধী। এর ঔজ্জ্বল্য দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং পরিবেশের প্রভাবে সাধারণত জারণ, বিকৃতি বা ক্ষয়ের মতো ক্ষতি খুব একটা হয় 
না। ফলে দৈনিক ব্যবহারে এর কোনো সমস্যা হয় না।

যেহেতু আধুনিক চীনা স্বর্ণ ৯৯.৯% বিশুদ্ধ এবং এর বৈশিষ্ট্য বর্ধনের জন্য সামান্য যে সংকর যোগ করা হয়েছে, তা এর খাঁটি স্বর্ণ হওয়ার পরিচয় নষ্ট করেনি, তাই ফিকহি দৃষ্টিকোণ থেকে এটি সম্পূর্ণ খাঁটি স্বর্ণের বিধান লাভ করবে।


তোমরা সোনা ও রুপার পাত্রে পান করবে না এবং এর থালায় খাবে না।
সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৪৩১
স্বর্ণের পাত্রে ব্যবহার: অধিকাংশ ফকিহগণের মতে, এই স্বর্ণের পাত্রে পানাহার করা বা অজু করা হারাম। যদিও অজু বা গোসল শুদ্ধ হবে, কিন্তু পাত্র ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। 
রাসুল (সা.) বলেছেন, “তোমরা সোনা ও রুপার পাত্রে পান করবে না এবং এর থালায় খাবে না।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৪৩১)

পুরুষের জন্য অলংকার: পুরুষদের জন্য এই স্বর্ণের আংটি বা অন্য কোনো অলংকার ব্যবহার করা সম্পূর্ণভাবে হারাম। কারণ, রাসুল (সা.) পুরুষদের স্বর্ণের আংটি ব্যবহার করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৮৬৫)


জাকাতের আবশ্যকতা: আধুনিক চীনা স্বর্ণ নিসাব পরিমাণ (৮৫ গ্রাম) হলে এর ওপর জাকাত দেওয়া ওয়াজিব হবে। এখানে জাকাতের জন্য আলাদা করে ভেতরের ০.১% মিশ্রণের মূল্য বাদ দেওয়ার প্রয়োজন নেই।


দন্তচিকিৎসায় ব্যবহার: চিকিৎসাগত প্রয়োজনে দাঁতে এই স্বর্ণ ব্যবহার করা বৈধ। কারণ, আরফাজাহ ইবনে আসআদ (রা.)-এর নাক যুদ্ধে কেটে গেলে তিনি প্রথমে রূপার নাক লাগান, কিন্তু তাতে দুর্গন্ধ হওয়ায় রাসুল (সা.) তাকে স্বর্ণের নাক লাগানোর নির্দেশ দেন। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১৭৭০; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪২৩২)


এটি প্রয়োজনে ব্যবহারের একটি বৈধতার ভিত্তি।


ক্রয়-বিক্রয় ও সুদ:

স্বর্ণের সঙ্গে স্বর্ণের বিনিময়: এই স্বর্ণের সঙ্গে এর সমজাতীয় স্বর্ণ (আধুনিক চীনা স্বর্ণ) বা প্রচলিত স্বর্ণের কম-বেশি করে বিনিময় করা সম্পূর্ণরূপে হারাম। কেননা, তাতে সুদ 
হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, “স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ, রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য, যবের বিনিময়ে যব, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর এবং লবণের বিনিময়ে লবণ সমান সমান, হাতে হাতে নগদ আদান-প্রদান করতে হবে। যে ব্যক্তি কম বা বেশি দেবে বা নেবে, সে সুদ নেবে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৫৮৪)

সুতরাং, ওজন অবশ্যই সমান হতে হবে এবং নগদ লেনদেন সম্পন্ন করতে হবে।


অন্যান্য দ্রব্যের সঙ্গে বিনিময়: অন্যান্য বস্তু (যেমন: রৌপ্য বা টাকা) দিয়ে এই স্বর্ণ ক্রয়-বিক্রয় করা বৈধ, এমনকি মূল্যে কম-বেশি হলেও তা বৈধ।


ব্যাংকিং কার্ডের মাধ্যমে ক্রয়: ব্যাংক কার্ডের মাধ্যমে আধুনিক চীনা স্বর্ণ ক্রয় করা বৈধ, তবে শর্ত হলো—লেনদেনটি নগদে সংঘটিত হতে হবে। অর্থাৎ, টাকা বিক্রেতার অ্যাকাউন্টে তাৎক্ষণিকভাবে জমা হতে হবে এবং সেই একই সময়ে ক্রেতা স্বর্ণ বুঝে নিতে হবে। লেনদেনে কোনো প্রকার বিলম্ব বা বাকি রাখা যাবে না।


সার কথা
পুরানো চীনা স্বর্ণ মূলত ভেজাল বা প্রলেপ দেওয়া ধাতু হওয়ায় ফিকহের দৃষ্টিতে তা স্বর্ণের বিধান লাভ করত না। কিন্তু আধুনিক চীনা স্বর্ণ ৯৯.৯% খাঁটি এবং এতে বৈশিষ্ট্য বর্ধনের জন্য যে সামান্য মিশ্রণ আছে, তা এর মৌলিক পরিচয়কে পাল্টায়নি।


এর বর্ধিত স্থায়িত্ব, কাঠিন্য ও ঔজ্জ্বল্য এটিকে দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য উপযোগী করে তুললেও ফিকহি দৃষ্টিকোণ থেকে এটি প্রচলিত খাঁটি স্বর্ণের সকল বিধান লাভ করেছে। তাই এই স্বর্ণ ক্রয়-বিক্রয়, জাকাত এবং পুরুষের ব্যবহার সংক্রান্ত সকল বিধিবিধান প্রচলিত স্বর্ণের মতোই প্রযোজ্য হবে।