সোমবার   ১৩ অক্টোবর ২০২৫   আশ্বিন ২৭ ১৪৩২   ২০ রবিউস সানি ১৪৪৭

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
১৪

গৌরবময় ইতিহাসের কুমিল্লা

প্রকাশিত: ১২ অক্টোবর ২০২৫  

কুমিল্লা জেলা মানে গৌরবময় ইতিহাসের সাথে সম্বৃদ্ধ বর্তমান।অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা থেকে শুরু করে এমন কোন জায়গা নেই যেখানে কুমিল্লার সফলতা নেই।

 

কুমিল্লার তাঁত,কুটির, মৃৎ ও কারুশিল্পের পাশাপাশি রসমালাই, মিষ্টি ও ময়নামতির শীতল পাটি সারা দেশে বিখ্যাত। বর্তমানে কুমিল্লা যেন সম্পদের এক জীবন্ত ভান্ডার। দেশের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্যাস ক্ষেত্র এই জেলায় অবস্থিত।

 

কুমিল্লার অর্থনীতি খুবই মজবুত। এই অঞ্চলের দারিদ্র্যতার হার দেশের অন্যান্য অঞ্চলের থেকেও কম।প্রাচীন ও মোগল আমলের অসংখ্য মসজিদ কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য কে মহিমান্বিত করেছে।

 

কুমিল্লা জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ সমৃদ্ধ শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। ঐতিহাসিক এই জেলাটি সপ্তম থেকে অষ্টম শতাব্দীর বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের আশ্রয়স্থল। এখানে অবস্থিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈন্যদের কবরস্থানটি কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশন দ্বারা রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।

 

এক সময়কার বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের প্রধান উপাসনালয় শালবন বৌদ্ধ বিহারের অবস্থান কুমিল্লার কোটবাড়িতে। এখানকার বনে প্রচুর পরিমাণে শাল গাছ থাকায় স্বভাবতই বিহারটির শালবন বিহার নাম হয়েছে। বিহারে মোট ১৫৫টি কক্ষ আছে, যেখানে ধর্মচর্চা করতেন বুদ্ধের অনুসারিরা।
এই বিহার থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৪০০টি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, ব্রোঞ্জ ও মাটির মূর্তি, সিলমোহর, আটটি তাম্রলিপি এবং অসংখ্য পোড়া মাটির ফলক বা টেরাকোটা পাওয়া গেছে।

কুমিল্লার ময়নামতিতে অবস্থিত  রাণী ময়নামতির প্রাসাদ।এই পুরাকীর্তিটির নির্মাণকাল ৮ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মাঝের কোনো সময়। সে সময় চন্দ্র বংশের রাজা মানিক চন্দ্র তার স্ত্রী ময়নামতির আরাম আয়েশের জন্য বানিয়ে দেন এই প্রাসাদ।
১৯৮৮ সালে ভূপৃষ্ঠ থেকে তিন মিটার গভীরে থাকা একটি সুড়ঙ্গের সামনে খননের সময় আবিষ্কৃত হয় এই প্রাসাদ। প্রতি বৈশাখের ৭ম দিন থেকে এখানে মাসব্যাপী উদযাপন হয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বৈশাখী মেলা।
 এছাড়াও আনন্দ বিহার
কোটবাড়ির ময়নামতিতে অবস্থিত স্থাপনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় এই বিহারটি ছিলো উপমহাদেশের সর্বশেষ বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়। এটি নির্মাণ করেছিলেন দেব রাজবংশের তৃতীয় শাসক শ্রী আনন্দ দেব ৭ম অথবা ৮ম শতাব্দীর প্রথম দিকে। ধারণা করা হয়, ৭ম শতকের শেষ সময়ে এই বিহার ছিলো সমতটের রাজধানী।

নান্দনিক বর্গাকৃতির বিশাল অবকাঠামোর ঠিক মাঝখানে রয়েছে কেন্দ্রীয় মন্দির এবং অপরূপ এক দিঘি।

কুমিল্লার ঐতিহাসিক নিদর্শনের এক গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহশালা  ময়নামতি জাদুঘর, যার অবস্থান কুমিল্লা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে সালমানপুরে। জাদুঘরের ৪২ টি ভিন্ন ভিন্ন সংরক্ষণাগার ঘুরে দেখার সময় চোখে পড়বে ব্রোঞ্জ ও পাথরের ছোট-বড় মূর্তি, স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, ব্রোঞ্জের বিশাল ঘন্টা, পোড়ামাটির ফলক, মাটির খেলনা, কাঠের পুরানো জিনিসপত্র, মৃৎশিল্প সামগ্রী এবং প্রাচীন হাতে লেখা পান্ডুলিপি।

কুমিল্লার চারপত্র, রূপবান ও কোটিলা মুড়া, শ্রীভবদের মহাবিহার, ইটাখোলা, রানীর বাংলা ও ভোজ রাজবাড়ি বিহার এবং আনন্দ বিহার খননকালে খুঁজে পাওয়া যায় এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো। আঙ্গিনার বিশ্রামাগার আর ফুল বাগান জাদুঘরের সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ১৯৬৫ সালে।

কোটবাড়ির শালবন বিহারের পাশেই স্থাপন করা হয় এই জাদুঘর।এছাড়াও কুমিল্লার বিখ্যাত ধর্মসাগর দীঘি কুমিল্লা সদরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি দর্শনীয় স্থানটি।  ১৭৫০ থেকে ১৮০৮ সালে রাজা ধর্মপালের শাসনামলে রাজ্যে এক ভয়ানক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তখন পাল বংশের এই জনদরদী রাজা প্রজাদের কষ্ট দূর করার জন্য খনন করে দেন ধর্মসাগর দীঘিটি। অতঃপর তার নামেই দীঘিটি প্রসিদ্ধি লাভ করে।

কুমিল্লার অর্থনীতির মূল চাবিকাঠি কৃষি হলেও এই জেলার প্রায় ১১ শতাংশ মানুষ ব্যবসার সাথে জড়িত। কুমিল্লায় ২ টি শিল্পনগরী রয়েছে। শুধুমাত্র অর্থনীতি ও প্রাকৃতিক সম্পদের কারনে নয়,বরং বিভিন্ন খাতে দেশের অগ্রযাত্রায় অবদান রাখছে কুমিল্লা। কুমিল্লায় ১ টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও ৪ টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। পাশাপাশি ১ টি সরকারি মেডিকেল কলেজ ও ৩ টি বেসরকারী মেডিকেল কলেজ সহ রয়েছে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

কুমিল্লায় জন্ম হযেছে অনেক গুণীজন যারা তাঁদের কাজের মাধ্যমে ইতিহাসের পাতায় নিজেদের নাম লিখিয়েছেন।বঙ্গীয় কংগ্রেসের সভাপতি বসন্ত কুমার মজুমদার,ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্নিকন্যা হেমপ্রভা মজুমদার,  ভাষা সৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্র নার্থ দত্ত এবং বিখ্যাত গীতিকার শচীন দেব বর্মন কুমিল্লার কৃষি সন্তান ছিলেন।এছাড়াও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার প্রথম রূপকার শিব নারায়ণ দাশ,কবি ও নারী নেত্রী সুফিয়া কামাল,প্রাবন্ধিক মোতাহার হোসে, আবুল খায়ের মোসলেহ উদ্দিন, প্রমুখ এই জেলার আলো বাতাস গাঁয়ে মেখে বেড়ে উঠেছেন।

দেশের বিভিন্ন আন্দোলনের সাথে কুমিল্লার সম্পৃক্ততার ইতিহাস রয়েছে। ১৭৬৪ সালে শমসের গাজীর নেতৃত্বে সংগঠিত ত্রিপুরার রাজাদের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন কুমিল্লার ইতিহাসে উজ্জ্বল ঘটনা।এছাড়া প্রিন্স ওয়াল্যাসের ভারত ভ্রমনের প্রতিবাদে ১৯২১ সালে দেশব্যাপী ধর্মঘটের নেতৃত্বে কুমিল্লাবাসী সক্রিয় ভাবে অংশ গ্রহন করেছিল। সেই সময়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কুমিল্লায় অবস্থা করেছিলেন এবং তিনি বিভিন্ন দেশাত্মবোধক গান এবং কবিতা লিখে কুমিল্লার জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। 

কুমিল্লা এক সময় বর্তমান ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ ছিল। ১৭৩৩ সালে বাংলার নবাব সুজা উদ্দিন খান ত্রিপুরা রাজ্য আক্রমণ করে এর সমতট অংশ সুগা বাংলার অন্তর্ভুক্ত করে।১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ত্রিপুরা দখল করে এরপর ১৭৯০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন আমলে ত্রিপুরা জেলার সৃষ্টি হয়।পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে বর্তমান ভারতের ত্রিপুরা থেকে আলাদা করে কুমিল্লা কে জেলা হিসাবে মর্যদা দেয়া হয়।

 কমলাস্ক বা পদ্মের পুকুর শব্দ থেকে কুমিল্লা নামের উৎপত্তি। বর্তমানে কুমিল্লা কুমিল্লা জেলার আয়তন ৩০৮৭ বর্গ কিঃ মি এবং লোকসংখ্যা ৬২ লক্ষ ১২ হাজার।

ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসাবে পরিচিত এই জেলা কালের বিবর্তনে এসেছে অনেক পরিবর্তন আবার অনেক কিছু হারিয়েও গেছে।

এই বিভাগের আরো খবর