মঙ্গলবার   ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫   পৌষ ১৫ ১৪৩২   ১০ রজব ১৪৪৭

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
৩৯৭

পিলিভিট : অ‍্যা রিয়েল সাগা

শাহরিয়ার শ্রাবণ

প্রকাশিত: ২ আগস্ট ২০২৩  

ফটোগ্রাফার: সুদীপ দাস

ফটোগ্রাফার: সুদীপ দাস

হিমালয়ের পাদদেশ ঘেঁষে ভারত-নেপাল সীমান্তে এক বৈচিত্র্যময় পরিবেশ দ্বারা পরিবেষ্টত পিলিভিট টাইগার রিজার্ভ যা উচ্চ গাঙ্গেয় সমতল জৈব-ভৌগলিক প্রদেশের তরাই আর্ক ল্যান্ডস্কেপের অংশ। জঙ্গলের ধার বেয়ে বয়ে চলেছে অসংখ্য ছোট ছোট ক‍্যানাল / নদী। আর সেই নদীর পাড়ে জঙ্গলের শেষ প্রান্তে আছে হাজার মানুষের বাস। যাইহোক জীবন সংগ্রামের এক কঠিন বাস্তব গল্পের জন‍্য বছর ছয়েক পিছনে ফিরে যাওয়া যাক....পিলিভিটের অন্দরমহলে। সময়টা ২০১৭ র আশেপাশে। নোটবন্দীর পর আবার সাধারণ মানুষ আস্তে আস্তে জীবনের ছন্দ ফিরে পাওয়ার পথে। UPI, Paytm, ডিজিটাল ইন্ডিয়া নয়, তাদের লক্ষ্য ডে টু ডে জীবনধারণ। ভাগ্যদেবী এখানে খুব একটা সুপ্রসন্ন নয়। খাদ্যের জন্য নিয়ত সংগ্রাম এই ছন্নছাড়া মানুষদের। কখনো খাদ্যের খোঁজে বনে গিয়ে পড়তে হচ্ছে হিংস্র পশুর কবলে। দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের জোগাড়ও এদের হয়ে ওঠে না। সরকারও এসব গ্রামের প্রতি বেশ উদাসীন। উপরন্তু সদ‍্য সদ‍্য "টাইগার রিজার্ভ" ঘোষিত হওয়ার জন্য বন বিভাগের আইনের কড়াকড়ি। নিরুপায় হয়ে গ্রামবাসী খুঁজে নিলেন অভিনব কিন্তু হৃদয় বিদারক এক পন্থা। অভাবের রোষানলে খুঁজে পাওয়া এই অদ্ভুত চিন্তাটাকে বাস্তব বিবেচনায় মানবতার পরিপন্থীই বলা যায়। জঙ্গলের রক্ষণাবেক্ষণ, বন‍্যপ্রাণী ও মানুষের সহাবস্থানের জন্য সেখানে গড়ে উঠেছে ‘পিলিভিট বাঘ সংরক্ষণ কেন্দ্র’ বা ‘পিটিআর’। শিকার এবং শিকারির সামঞ্জস্যপূর্ণতা রক্ষা করাই এ কেন্দ্রের মূল লক্ষ্য। ৮০০ বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে এই জঙ্গলে বাঘের আবাসভূমি। পি টি আরের তখনকার হিসেব অনুযায়ী প্রায় ৩৬টির উপর বাঘের আশ্রয়স্থল এই পিলিভিট জঙ্গল। পিলিভিট জঙ্গলের পাশেই একটি ছোট্ট গ্রাম। এ গ্রামেই একদিন সকালে গ্রামবাসীরা যখন জীবিকার খোঁজে বের হয়েছে, তখন গ্রামের শেষদিকে জঙ্গলের পাশের খোলা জমিতে একটি মৃতদেহ পাওয়া গেল। সাড়া পড়ে গেল চারিদিকে। লাশের আধ-খাওয়া শরীর দেখে বুঝতে বাকি রইল না, এ বাঘের কীর্তি। খোঁজ নিতেই নিহত বৃদ্ধের বাড়ির ঠিকানা পাওয়া গেল। পরিবারের সকলেই শোকের পরিবর্তে তড়িঘড়ি করে পিটিআরে খবর দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পিটিআর থেকে লোক এসে সরেজমিনে তদন্ত করে বাঘের থাবাতেই বৃদ্ধ হত্যা হয়েছে বলে প্রমাণ পেল। ভারতে বন বিভাগের আইন বেশ কড়া। কেন্দ্র সরকারের নিয়ম অনুযায়ী, বন্য জন্তুর হামলায় মৃত্যু হলে মৃতের পরিবারকে ১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। আক্রান্ত পরিবার খুব দ্রুতই ক্ষতিপূরণ পেয়ে গেল। সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু গোলমালটা শুরু হলো ক্ষতিপূরণ পাওয়ার পর থেকে। বাঘের আক্রমণে মৃত্যুর এই ঘটনা ঘটে ওই বছরের শুরুর দিকে। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাস শুরু হতেই, প্রথম পনের দিনের মাথায় সেই গ্রামে বাঘের কবলে মৃত্যুর সাত-সাতটি অভিযোগ জমা পড়ে পিটিআরে! কর্তৃপক্ষের তখন টনক নড়ে ওঠে। কারণ পিলিভিটের জঙ্গলটি ছিল বেশ গভীর এবং সেখানে হার্ভিভোর (তৃণভোজী) সংখ্যাও কম নয়। বাঘের খাদ্যের অভাব হবার কথা নয়। আর নিতান্তই খাদ্যের অভাব না হলে বাঘ সাধারণত লোকালয়ে আসে না। এটা আরও চিন্তার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, কারণ বাঘ কোনো গরু-ছাগল না মেরে সরাসরি মানুষের উপর আক্রমণ চালাচ্ছিল। ব‍্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে গরু, ছাগল জঙ্গলের ধারে দিব‍্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে, দিনের শেষে বাড়ি ফিরে আসছে, আর মানুষ টপাটপ বাঘের পেটে চলে যাচ্ছে।পিটিআর-এর এক জরুরি বৈঠকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে গিয়ে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্যের সম্মুখীন হয়। গ্রামের যে ক’জন বাঘের শিকার হয়, তাদের সকলেই ছিলেন বয়সে বৃদ্ধ। পাশাপাশি বাঘের থাবায় নিহত লাশগুলো জঙ্গলের ভেতরে কোথাও পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে জঙ্গলের বাইরে, লোকালয়ে। অর্থাৎ দেখে মনে হচ্ছিলো বাঘ লোকালয়ে এসে এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। পিটিআর কর্মকর্তারা এই ব্যাপারে উর্দ্ধতনদের অবহিত করলে ব্যাপারটি নিয়ে ব্যাপক সন্দেহের সৃষ্টি হয়। ফলে পুরো বিষয়টি তখন কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত সংস্থা ওয়াইল্ডলাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ব্যুরো (ডব্লিউসিসিবি) বা বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ব্যুরোকে জানানো হয় এবং তাদের  পিলিভিট এলাকায় সংঘটিত বাঘের হামলায় মৃত্যুর ঘটনাগুলো তদন্তভার দেওয়া হয়। WCCB পিটিআর ও এর আশপাশে হওয়া এ ধরনের হামলাগুলো যাচাই করে। প্রতিটি ঘটনা ও মৃতদেহ উদ্ধারের স্থানগুলো আলাদা আলাদা করে খতিয়ে দেখে। গ্রামের নিহতদের পরিবারের সাথে কথা বলে। কিন্তু কারো কাছ থেকে তেমন কোনো তথ্য উঠে আসেনি। "অ‍্যা ওয়েল প্ল‍্যানড স্ক্রিপ্ট", যেখানে মৃত ও জীবিত মানুষেরা খুব নিপুণভাবে অভিনয় করে গেছেন। পর্দার সিনেমার মতো পরিচালক কিন্তু এখানে দেখাতে পারতেন না "গল্পটি একটি কাল্পনিক ঘটনা, যেখানে বাস্তবের সঙ্গে গল্পের বা চরিত্রের কোনো যোগাযোগ নেই। তদন্তের সময় এক কৃষকের প্রতি সন্দেহ হয়। তার বয়স ষাটের উপরে, নাম জার্নেইল সিং। তাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। প্রথমদিকে কিছুই বলতে চাইছিলেন না বৃদ্ধ। কিন্তু একসময় স্বীকার করেন, যেহেতু বাঘের অভয়ারণ্য বানিয়ে ফেলার কারণে বন থেকে আর সম্পদ আহরণ করা যাচ্ছে না, সেহেতু পরিবারকে দারিদ্র্য থেকে বাঁচাতে এটাই একমাত্র উপায়। তখন প্রশ্ন ওঠে, তাহলে কি পরিবারের লোকজনই বৃদ্ধদের জোর করে ঠেলে দিচ্ছে বাঘের মুখে? জার্নেইল সেই সন্দেহ নাকচ করে দিয়ে বলেন যে, সারাজীবন অনেক পরিশ্রম করেও যখন পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দিতে পারছিলেন না, তখন বাঘের হাতে মৃত্যুকেই শ্রেয় বলে মনে করেন তারা। তার মতে, গ্রামের বৃদ্ধরা স্বেচ্ছায় এই পরিকল্পনা করেন, যাতে করে পরিবারকে অনাহারে, অপুষ্টিতে মরতে না হয়। বাঘের হামলায় মৃত্যুর পর তাদের দেহ গ্রামের কাছে জমির মধ্যে ফেলে রাখা হয়, যাতে মনে হয় গ্রামে ঢুকে হামলা চালিয়েছিল বাঘ, আর তাতেই মৃত্যু হয়েছে বৃদ্ধদের। দেহে বাঘের হামলার চিহ্ন স্পষ্ট থাকে। কাজেই বন দপ্তরের কর্মীদের বোঝার উপায় থাকে না যে, এর পুরোটাই পরিকল্পিত। আর দেহ যদি বাঘের রিজার্ভের ভেতর থাকে তাহলে তারা কোনো ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে না। তাই দেহগুলোকে রিজার্ভ এরিয়া থেকে বের করে এনে লোকালয়ের জমিতে রাখা হয়। তদন্তের পর ঘটনার পুরো বিবরণ দিয়ে একটি রিপোর্ট জাতীয় বাঘ সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায় ওয়াইল্ড লাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ব্যুরোর তদন্তকারী অফিসার কলিম আথার। তদন্তে গ্রামের অভিবাসীদের দায়ী করে রিপোর্ট জমা দেয়া হয়। সম্প্রতি সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের "শেরডিল: দ্য পিলিভিট সাগা" সিনেমার সৌজন্যে এই ঘটনা অল্পবিস্তর অনেকেরই অজানা নয়। আমি শুধু গল্পের সঙ্গে আরও কিছু তথ্য সংগ্রহ করে পরিবেশনা করার চেষ্টা করেছি মাত্র। ঘটনাটি সত্য বা মিথ্যা বা স্ক্রিপ্টেড বা ম‍্যানুপুলেটেড যা-ই হোক না কেন, মূল প্রশ্ন মানবতার। এই সকল গরীব দুঃখী লোকেরা অত্যন্ত দুঃখ কষ্টের সঙ্গে জীবনযাপন করছে। বিশাল ভারতবর্ষ যেখানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় প্রতিদিন উন্নত রাষ্ট্রের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, ডিজিটাল ইন্ডিয়া, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের দোড়গোড়ায় আমাদের দেশ সেখানে এ ধরনের হৃদয় বিদারক ঘটনা সত্যিই নাড়া দিয়ে গেছে পুরো দেশকে। মানুষ কতটা নিরুপায় হলে বাঘের মুখে স্বেচ্ছায় গিয়ে পড়তে পারে, তা কোনো বর্ণনায় তুলে আনা সম্ভব নয়। আসলেই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা এমন কত ঘটনার সাক্ষী হই, যেখানে বাস্তবতা আর কল্পনা মিলে একাকার হয়ে যায়। প্রকৃতির মধ্যে ঘটে যাওয়া এমন বাস্তব ঘটনা জানার পর ‘জীবন থেকে গল্প, নাকি গল্প থেকে জীবন’- সেই বিষয়ে মনে অনেক প্রশ্ন জেগে ওঠে।

এই বিভাগের আরো খবর