বুধবার   ১০ ডিসেম্বর ২০২৫   অগ্রাহায়ণ ২৫ ১৪৩২   ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৭

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
১৭

আগস্টের পর দৃশ্যপট পাল্টাল

সুমন হোসেন

প্রকাশিত: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫  

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতির দৃশ্যপট নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বর্তমানে একইসঙ্গে দুটি ভিন্ন ফ্রন্ট বা প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করছে: একদিকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের রেখে যাওয়া প্রেতাত্মা ও সাইবার প্রোপাগান্ডা, অন্যদিকে একসময়ের জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ ও রাজনৈতিক কৌশল। এই ত্রিমুখী লড়াই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন ও জটিল অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

 

১৫ বছরের পুরনো প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের বিপরীতে এতদিন কেবল দ্বিমুখী লড়াই থাকলেও, ৫ আগস্টের পর সেই লড়াই এখন ত্রিমুখী। বিএনপিকে এখন যেমন সাইবার জগতে আওয়ামী লীগের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে, তেমনি রাজপথ ও রাজনৈতিক কৌশলে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে সরাসরি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে।

 

আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে এখন সংবাদপত্রের শিরোনাম দখল করেছে বিএনপি ও জামায়াতের পাল্টাপাল্টি হুঙ্কার। এই দ্বন্দ্বের মূল কারণ আগামী নির্বাচনে একক আধিপত্য বজায় রাখা।

 

তারেক রহমানের কড়া সমালোচনা: গত ৭ ডিসেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চ্যুয়ালি জামায়াতের নাম উল্লেখ না করেও তাদের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি ১৯৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকাকে পতিত স্বৈরাচারের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যার সঙ্গে তুলনা করেন এবং ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারকে 'শিরক' বলে কঠোর হুঁশিয়ারি দেন।

 

জামায়াতের পাল্টা জবাব: তারেক রহমানের বক্তব্যের জবাবে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান পরদিন ৮ ডিসেম্বর বলেন, "আমরা ধর্ম নিয়েই কাজ করি, ধর্মকে ব্যবহার করি না। নির্বাচনের সময় নতুন করে যারা বেশি বেশি নামাজ শুরু করেন, টুপি পরেন, ধর্মকে তারাই সম্ভবত ব্যবহার করেন।"

তৃণমূলে অভিযোগ: জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান সিলেটে এক সমাবেশে বিএনপিকে 'বেপরোয়া দখলদার' এবং 'আওয়ামী লীগের মতোই চাঁদাবাজ' শক্তি হিসেবে চিত্রিত করে গুরুতর অভিযোগ আনেন।

 

আধুনিক রাজনীতির হাতিয়ার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপিকে এখন দ্বিমুখী আক্রমণের মুখে পড়তে হচ্ছে:

 

আওয়ামী লীগের প্রোপাগান্ডা: ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতারা ও সমর্থকরা বিদেশ থেকে বিএনপির বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য ও প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে।

জামায়াতের সাইবার ক্যাম্পেইন: জামায়াতের একটি শক্তিশালী সাইবার ইউনিট তারেক রহমানের বক্তব্য খণ্ডন করে এবং বিএনপির অতীত নেতিবাচক কর্মকাণ্ড তুলে ধরে অনলাইন প্রচারণা চালাচ্ছে।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা লক্ষ্য করছেন, বিএনপিকে কোণঠাসা করতে জামায়াত এখন আওয়ামী লীগের বিশাল ভোট ব্যাংকের দিকে নজর দিয়েছে।

'আঁতাতের' অভিযোগ: বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু অভিযোগ করেছেন যে জামায়াত এখন আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাত গড়ে তুলছে।

 

জামায়াতের ব্যাখ্যা: জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে না থাকলে তাদের সাধারণ ভোটাররা এখন দেখবে 'কার কাছে তারা নিরাপদ, কাদের চরিত্র সৎ'। জামায়াত নেতাদের গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের আইনি সহায়তা দেওয়া এবং আওয়ামী লীগ নেতার কাছে ভোট চাওয়ার ঘটনাও এই কৌশলকে স্পষ্ট করে।

 

ক্ষমা ঘোষণা: জামায়াত আমির শফিকুর রহমান গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের নির্যাতনকে ক্ষমা করে দেওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাকে বিশ্লেষকরা একটি দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক চাল হিসেবে দেখছেন।

 

নির্বাচন কমিশন: প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এম নাসির উদ্দিন জানিয়েছেন, এ সপ্তাহের মধ্যেই নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হবে।

বিএনপি: দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তফসিল ঘোষণার পরপরই দেশে ফিরবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

 

বিএনপি বর্তমানে এক জটিল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গত ২৩ নভেম্বর থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছেন এবং চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়া স্থগিত হয়েছে। অন্যদিকে, তারেক রহমানের নির্বাসন শেষ হলেও তাকে দেশে ফিরে জামায়াত, আওয়ামী লীগের প্রেতাত্মা এবং দলের অভ্যন্তরের চ্যালেঞ্জ—এই ত্রিমুখী সংকট মোকাবিলা করে নির্বাচনে নেতৃত্ব দিতে হবে।

 

রাজনৈতিক মেরুকরণ: এই ত্রিমুখী লড়াই বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের পরিচিত দ্বিমুখী রাজনৈতিক সমীকরণ ভেঙে নতুন মেরুকরণ তৈরি করছে। জামায়াত এখন বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হওয়ায় উভয় দলের ভোট ব্যাংকে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।

নির্বাচনী কৌশল: বিএনপিকে এখন রাজপথের আন্দোলনের পাশাপাশি সাইবার যুদ্ধক্ষেত্রে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যদিকে, জামায়াতের কৌশলগত অবস্থান আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিশাল সংখ্যক ভোটারের ভাগ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

এই বিভাগের আরো খবর