বৃহস্পতিবার   ১৪ আগস্ট ২০২৫   শ্রাবণ ৩০ ১৪৩২   ১৯ সফর ১৪৪৭

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
৩৫

৫৮ লাখ টাকা উদ্ধারে জড়ালো ছাত্রদল, হয়রানির অভিযোগ

তরুণ কণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১৩ আগস্ট ২০২৫  

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলকর্মী আহসান হাবিব (বাঁয়ে) ও আল ইয়ামিম আফ্রিদি। ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ জনকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ৫৮ লাখ টাকা লেনদেন হয়। সেই টাকা উদ্ধারে গত বছরের ৫ আগস্টের পর ছাত্রদলের এক কর্মীর দ্বারস্থ হন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক শিক্ষার্থী। এজন্য ছাত্রদলের ওই কর্মীকে তিন লাখ টাকার একটি চেক দেন তিনি। সেই চেক উদ্ধারে আরও টাকা দাবি করেন ছাত্রদলের আরেক কর্মী।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী সাবিনা ইয়াছমিন এমন অভিযোগ এনেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের সভাপতি আলাউদ্দিন মহসিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত আহসান হাবিব ও আল ইয়ামিম আফ্রিদির বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অভিযোগ দেওয়ায় পাচ্ছেন হুমকিও। যদিও ছাত্রদলের ওই দুই অনুসারী সাবিনার অভিযোগ অস্বীকার করছেন।
সাবিনা ইয়াছমিনের অভিযোগ, গত ২৪ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসে অভিযোগ করার দিন রাতেই আহসান হাবিবের পক্ষ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের আরেক কর্মী আল ইয়ামিম আফ্রিদি ফোনে অভিযোগ প্রত্যাহারের চাপ দেন।

ঘটনার শুরু যেভাবে
জানা গেছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য শিরীণ আখতারের সময়ে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বিভিন্ন পদে ১৫ জনকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে সাবিনা ইয়াছমিনের কাছ থেকে ৫৮ লাখ টাকা নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নমান সহকারী এমরান হোসেন। ৫ আগস্টের পর শিরীণ আখতারের উপাচার্য পদ চলে গেলে এমরান ওই চাকরি দিতে পারেননি। টাকাও ফেরত দেননি সাবিনার। তবে অভিযোগ রয়েছে, সাবিনা ইয়াছমিনও এমরানের সঙ্গে নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন। মূলত চাকরিপ্রার্থী ‘ম্যানেজ’ করে দিতেন তিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এমরানের কাছ থেকে ওই টাকা উদ্ধারে ছাত্রদল সভাপতির অনুসারী আহসান হাবিবের দ্বারস্থ হন সাবিনা। এরপর বিষয়টি আলোচনায় এলে চলতি বছরের ২৫ মার্চ এমরান হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

দুই পক্ষের ফোনের কথোপকথন
জাগো নিউজের হাতে আসা ১৩ মিনিট ১২ সেকেন্ডের একটি ফোন রেকর্ড পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সাবিনা ইয়াছমিন ফোনের অপর প্রান্তে এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলছেন। কথোপকথনের একপর্যায়ে সাবিনা বলেন, ‘তুমি আবারও বলছো, চেক কেনো দিছি? হাবিবের সাথে একটি কথা হয়েছে, চেক দিছি।’

আরেক পর্যায়ে সাবিনা বলেন, ‘হাবিব আমার কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা চাইছে, এটা কি ঠিক? এত লোভ কেনো?’ কথোপকথনের ওই পর্যায়ে অপরপ্রান্তের ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়, ‘হাবিব ভাইয়েরা পলিটিক্যাল পারসন। এরা টাকা খাওয়ার ধান্দায় বইসা থাকে। এখন বিষয়টা মিটমাট করো, হ্যাঁ অথবা না বলো।’
রেকর্ডে ফোনের অপরপ্রান্তের ব্যক্তিটি ছাত্রদলকর্মী আল ইয়ামিম আফ্রিদি বলে জানান সাবিনা।
সাবিনা ইয়াছমিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি যেদিন (২৪ জুলাই) অভিযোগটি দিই, ওইদিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে মাহমুদ দোলন (সাবিনার ছোট ভাইয়ের বন্ধু) আমাকে ফোন দিয়ে আমার বাসায় আসতে চায়। বাসায় এসে দোলন আমাকে বলে, আপা ওরা চেকটি দিয়ে দিয়েছে। আমি হাবিবকে চেকটি দিয়েছিলাম দুই ভাঁজের। দোলন নিয়ে আসছে চার ভাঁজ করে। দোলনের চাওয়া হাবিবের দাবিকৃত ২০ হাজার টাকা দিলে চেকটা আমাকে দিয়ে যাবে। আমি রাজি না হলে পরের এক ঘণ্টায় দোলন আমার বাসায় তিনবার আসছে। চেকটি দোলনের হাতে ছিল। মূলত হাবিব- ইয়ামিমের হয়ে দোলন চেকটি নিয়ে আমাদের বাসায় আসে। তখন ২০ হাজার টাকা চাইলে আমি বলি, এখন আমাদের এক টাকা দেওয়ার মতো অবস্থাও নেই। আমি প্রক্টরের মাধ্যমে বিষয়টির সমাধান চাইবো।’


সাবিনা আরও বলেন, ‘দ্বিতীয়বার চলে যাওয়ার ১৫ মিনিট পর দোলন ফোন করে আবার আমার বাসায় আসে। ওদের (হাবিব- ইয়ামিম) হয়ে দোলন বলছে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চাপে অভিযোগ দিয়েছি উল্লেখ করে অভিযোগটি তুলে নিতে হবে। তখন আমি বলি সেটা সম্ভব নয়। তখন আমার ফোনে এক সাংবাদিকের ফোন আসে। তার (সাংবাদিকের) সঙ্গে কথা বলতে না বলতেই, দোলনের মোবাইলে ইয়ামিমের ফোন আসে। তখন দোলন আমাকে ফোনটি দেয় ইয়ামিমের সঙ্গে কথা বলতে। এ সময় কথা বলার ফাঁকে ইয়ামিমের সঙ্গে হওয়া কথোপকথনটি আমার মোবাইলে রেকর্ড (১৩ মিনিট ১২ সেকেন্ড) করি।’

এ বিষয়ে কথা হলে মাহমুদ দোলন জাগো নিউজকে বলেন, ‘মিতু (সাবিনা ইয়াসমিনের ডাক নাম) আপুর ছোট ভাই মাসুদ আমার বন্ধু। মিতু আপুর বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজনকে টাকা দিয়েছিল। কিন্তু তাদের কাছে কোনো ডকুমেন্ট ছিল না। মাসুদ আমার কাছে এ বিষয়ে সহযোগিতা চেয়েছিল। তাই আমি সহযোগিতা করার জন্য ওইদিন ফোনের অপরপ্রান্তের লোকটির সঙ্গে কথা বলেছি। অপরপ্রান্তের লোকটিকেও আমি চিনি না। মিতু আপু রেকর্ডটি আমার সামনে করেছিল। পুরো রেকর্ডটি সাজানো ছিল।’

হাবিবের কাছ থেকে চেক নেওয়ার বিষয়টি দোলন অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আপনার (প্রতিবেদক) কাছে কি কোন ডকুমেন্ট আছে? আমি তো এমরানকে চিনিই না। এখানে হাবিব আসবে কোথেকে? এখানে আমাকে ফাঁসাই দিতেছে। আমি ওনার (সাবিনা) সঙ্গে জীবনেও কথা বলবো না। আমাকে বলা হয়েছিল, দুই সেকেন্ডের ব্যাপার, আমি দুই সেকেন্ডের নাটক করে দিছি। আমি আল ইয়ামিম আফ্রিদিকেও চিনি না।’

তবে সিডিআর (কল ডিটেইল রেকর্ড) পর্যালোচনায় মাহমুদ দোলন নিজের ব্যবহৃত ৩৬৮৩ এবং ৩৮৭২ (শেষ চার ডিজিট) নম্বরের মুঠোফোন থেকে আল ইয়ামিম আফ্রিদির ব্যবহৃত ৪৬৪৪ (শেষ চার ডিজিট) নম্বরের মুঠোফোনে ২৪ জুলাই পর্যন্ত একাধিকবার কথা বলার প্রমাণ মেলে।

৫৮ লাখ টাকা উদ্ধারে জড়ালো ছাত্রদল, হয়রানির অভিযোগ

সাবিনা ইয়াছমিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন চেকটি হাবিবের কাছে আছে। হাবিবের হয়ে ইয়ামিম বলেছে চেকটি তার (হাবিবের) কাছ থেকে ২০ হাজার টাকায় কিনে নিতে হবে। তখন আমি তাকে (ইয়ামিম) বলেছি, আমার চেক আমি প্রশাসনিকভাবে নেবো।’


মেয়াদোত্তীর্ণ চেক কেন দেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে সাবিনা ইয়াছমিন বলেন, ‘উনি (হাবিব) ক্যাশ টাকা উঠায় (উত্তোলন) দেবে এ শর্তে চেকটি আমার কাছ থেকে নিয়েছে। চেকটি ২০২৪ সালের ১২ মার্চ তারিখের। চেকটি নিয়েছে গত ২০ জানুয়ারি সন্ধ্যায়। এটি ছিল অগ্রণী ব্যাংক বিশ্ববিদ্যালয় শাখার। উনাদের (হাবিব-ইয়ামিম) কথা মেনে না নেওয়ায় আমি হয়রানির শিকার হচ্ছি। বিভিন্ন জায়গায় নানা ধরনের বক্তব্য দিয়ে বেড়াচ্ছে।’

যা বলছেন আহসান হাবিব ও আল ইয়ামিম আফ্রিদি
এসব অভিযোগের বিষয়ে জাগো নিউজের কথা হয় আহসান হাবিব ও আল ইয়ামিম আফ্রিদির সঙ্গে। আহসান হাবিব মাইক্রোবায়োলজি ও ইয়ামিম বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী। তারা দুজনই ছাত্রদলের নতুন কমিটিতে পদপ্রত্যাশী।

প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের রাজনীতির বিষয়ে কথা হলে আহসান হাবিব জাগো নিউজকে বলেন, ‘চবি ছাত্রদলের পাঁচ সদস্যের কমিটি রয়েছে। এখন কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার বিষয়টি অনপ্রসেস। যারা বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সময়ে আন্দোলন সংগ্রামে ছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রদল তাদেরকে মূল্যায়ন করবে।’

নিজের প্রত্যাশিত পদের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি নির্ধারিত কোনো পদ চাইনি। তবে দল যেভাবে আমাকে মূল্যায়ন করে, সেভাবে হবে।’

সাবিনার কাছ থেকে তিন লাখ টাকার চেক নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে আহসান হাবিব বলেন, ‘তিনি (সাবিনা ইয়াছমিন) বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে প্রতারক এমরানের সঙ্গে নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন। প্রতারক এমরান তার কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। তার (সাবিনা) ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়লেও ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিল।’

২০ হাজার টাকা দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এগুলো প্রোপাগান্ডা। আমি চেকও নেইনি। কোনো টাকাও চাইনি।’


হাবিবের হয়ে প্রক্টর অফিস থেকে অভিযোগ প্রত্যাহারে সাবিনাকে চাপ দেওয়ার বিষয়ে আল ইয়ামিম আফ্রিদি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমিও গণমাধ্যম কর্মী। চাইলে গণমাধ্যমে কেউ অভিযোগ দিতে পারেন না। প্রতিবেদকও অভিযোগের বিষয়টি দাবি করতে পারেন না। আমার বিরুদ্ধে প্রশাসনের কাছে লিখিত ও মৌখিক কোনো অভিযোগ নেই।’

ইয়ামিম আরও বলেন, ‘সাবিনা ইয়াছমিন একজনের কাছ থেকে টাকা পান। সে বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের জন্য তার সঙ্গে অনেক আগে থেকে আমিসহ অনেক সাংবাদিকের কথা হয়েছে। ওরা (এমরান, সাবিনা) নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িত ছিল, ফ্যাসিবাদের দোসর ছিল। সে জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তাদের পক্ষে কোনো নিউজ করবো না।’

ফোনে কথোপকথনের বিষয়ে ইয়ামিম বলেন, ‘ফোন রেকর্ড থাকলে সেটার বিষয়ে ফরেনসিক রিপোর্ট লাগবে। কল হিস্ট্রি লাগবে। সেটা না থাকলে, কোনো প্রমাণ ছাড়া কল রেকর্ডটা আমার দাবি করা যাবে না। আপনি (প্রতিবেদকের) পছন্দের বক্তব্য দাবি করতে পারেন না। তাদের হয়ে আপনি (প্রতিবেদক) কথা বলছেন।’

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভাষ্য
জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন
সাবিনার অভিযোগের বিষয়ে প্রক্টর অধ্যাপক ড. তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফ বলেন, ‘তিন লাখ টাকার একটি চেকের বিষয়ে আমাদের কাছে একটি অভিযোগ এসেছে। তবে এটি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত নয়। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি আমাদের শিক্ষার্থী হলেও যিনি অভিযোগকারী তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থী নন। চেকের বিষয়টি তাদের ব্যক্তিগত। তারপরেও ওই চেক নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো মামলা কিংবা আইনি কোনো পদক্ষেপ রয়েছে কি না, সেটা জানার পর প্রক্টরিয়াল বিধিতে পরবর্তী কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সেটা দেখা হবে।’

এই বিভাগের আরো খবর