বুধবার   ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫   পৌষ ১০ ১৪৩২   ০৪ রজব ১৪৪৭

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
১০

এবার ‘ভিউ ব্যবসায়ীদের’ নিষ্ঠুর গুজবের কবলে শোকাতুর বাবা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫  

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে গত ৮ ডিসেম্বর নিজ বাসায় নির্মমভাবে খুন হন লায়লা আফরোজা (৪৮) ও তাঁর নবম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে নাফিসা নাওয়াল বিনতে আজিজ (১৫)। শোকের এই পাহাড় মাথায় নিয়ে যখন বিচার পাওয়ার লড়াই করছেন মানসুরা স্কুলের শিক্ষক আ জ ম আজিজুল ইসলাম, ঠিক তখনই তিনি পড়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তথাকথিত ‘ভিউ ব্যবসায়ীদের’ নিষ্ঠুর কবলে।

 

ফেসবুক ও ইউটিউবের কিছু অপেশাদার কনটেন্ট ক্রিয়েটর দাবি করছেন, এই জোড়া খুনের পেছনে খোদ আজিজুল ইসলামের হাত রয়েছে। এমন ভিত্তিহীন অভিযোগে মানসিকভাবে পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন তিনি।

 

 

আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে তাঁর যন্ত্রণার কথা জানিয়ে বলেন,

 

"অনেকে বলতে চাইছেন, খুনের পেছনে নাকি আমার হাত আছে। স্ত্রীহারা, সন্তানহারা বাবার জন্য এটা যে কত কষ্টের ও যন্ত্রণার, তা বলে বোঝাতে পারব না।"

 

অথচ পুলিশ তদন্ত শেষে স্পষ্ট জানিয়েছে, এই হত্যাকাণ্ডে আজিজুল ইসলামের কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেজবাহ উদ্দিন বলেন,

 

"লায়লা আফরোজের স্বামী কোনোভাবে জড়িত—সে রকম কোনো তথ্য আমরা পাইনি। ফেসবুকে অনেকে কেবল ভিউ পাওয়ার আশায় এসব গুজব ছড়াচ্ছে।"

 

 

মামলার প্রধান আসামি গৃহকর্মী আয়েশা ইতিমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, চুরি করে পালানোর সময় লায়লা আফরোজা তাঁকে ধরে ফেললে এবং পুলিশে দেওয়ার কথা বললে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ছুরিকাঘাত করেন। মাকে বাঁচাতে এলে নাফিসাকেও খুন করেন তিনি। সিসিটিভি ফুটেজেও দেখা গেছে, বোরকা পরে আসা আয়েশা পালানোর সময় নিহত নাফিসার স্কুলড্রেস পরে বেরিয়ে যাচ্ছেন।

 

 

আজিজুল ইসলাম এখন আর মোহাম্মদপুরের সেই রক্তমাখা ফ্ল্যাটে থাকতে পারছেন না। ধানমন্ডিতে বোনের বাসায় থাকছেন তিনি। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, বিয়ের পর থেকে স্ত্রীকে ভালোবেসে ডাকতেন ‘নীনা বউ’। মেয়েকে ডাকতেন ‘জাদু বাবা’। খুনের আগের দিনই মেয়ের জন্য মেরুন রঙের একজোড়া জুতো কিনেছিলেন স্কুল পার্টির জন্য—সেটিই ছিল মেয়ের জন্য তাঁর শেষ উপহার।

 

আর্থিক প্রাচুর্যের গুজব উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, "আমি ব্যাংক লোন নিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছি। কোচিং আর স্কুলের বেতনের টাকায় কিস্তি শোধ করি। অনেকে অতিরঞ্জিত তথ্য ছড়াচ্ছেন।"

 

 

মিথ্যা তথ্যের এই ভয়াবহতা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম খান বলেন,

 

"আমরা এখন এক ‘সত্য-উত্তর’ (Post-truth) যুগে বাস করছি। যেখানে ফেক নিউজ মানুষকে প্রতিনিয়ত বিভ্রান্ত করছে। কোনো অপরাধ না করেও যখন কাউকে দায়ী করা হয়, তখন সেই মানুষটি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন।"

 

মা-মেয়ের হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত বিচার যখন সন্নিকটে, তখন ভিউ ব্যবসার এই নোংরা রাজনীতি একজন স্বজনহারা মানুষের ক্ষতকে আরও গভীর করে তুলছে।

এই বিভাগের আরো খবর