সোমবার   ০৬ অক্টোবর ২০২৫   আশ্বিন ২০ ১৪৩২   ১৩ রবিউস সানি ১৪৪৭

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
৪০০

মাকে কেন নির্মমভাবে খুন করল জমজ দুই বোন?

প্রকাশিত: ১ জুন ২০১৯  

জেসমিয়া হোয়াইটহেড নামের এক মেয়ে রাস্তায় চিৎকার করতে করতে দৌড় দিলেন। এরপর তিনি জর্জিয়াতে তার বাড়ির কাছে পুলিশের গাড়ির দিকে হাত নাড়িয়ে থামতে বললেন। পুলিশকে তিনি জানালেন যে, তিনি এবং তার যমজ বোন তাসমিয়া স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে এসে বাথটাবে তাদের মায়ের মৃতদেহ দেখতে পেয়েছেন। 

নিহত ওই মায়ের নাম জারমেকা 'নিক্কি' হোয়াইটহেড, বয়স ৩৪। তাকে কিচেনের ছুরি দিয়ে ৮০ বার ছুরিকাঘাত করা হয়। বাড়িতে তিনি ১৬ বছর বয়সী দুই মেয়ে এবং প্রেমিকের সঙ্গে বসবাস করতেন। কার্পেটে, দেয়ালের উপর, লিভিং রুমে এবং বাথরুমের মধ্যে রক্তের দাগ ছিল।  

পুলিশ কর্মকর্তা ক্রিস মুন সংবাদমাধ্যম এনবিসিকে বলেন, এটি ছিল আমার দেখা সবচেয়ে ভয়ানক রক্তাক্ত দৃশ্য, যা আমি আগে দেখিনি।  

২০১০ সালের ১৩ জানুয়ারি বিকেলে তদন্তকারীরা অপরাধস্থলে আসার পর ভয়াবহ আশঙ্কা থেকে মেয়েদেরকে স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। 

পথিমধ্যে তাসমিয়া তার হাত কামড়াতে শুরু করেন যা তার একটি স্নায়বিক অভ্যাস। কর্মকর্তাদের এ বিষয় তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান, মন খারাপ থাকলে তিনি এমনটা করেন। 

এর কিছুক্ষণ পর গোয়েন্দারা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। 

ডিটেক্টিভ কেনি সুইফ্ট সংবাদমাধ্যম ক্রাইম ডেইলিকে বলেন, এই দুই মেয়ে একে অপরকে গাঢ় আলিঙ্গন করছিলেন। যখন আমি বললাম, এটা তোমাদের পক্ষে সহজ করার জন্য আমি কী করতে পারি? তারা তখন আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললেন, আমরা কি 'সিএসআই' দেখতে পারি?

তিনি বলেন, তাদের দেখতে খুবই নির্দোষ এবং মিষ্টি লাগছিল।

জেসিয়া ও তাসমিয়াহ বা জাস-তাস যখন জন্ম নেন তখন নিক্কির বয়স ছিল ১৭ বছর। মেয়েরা ১৩ বছর বয়সে নিক্কির হেফাজতে আসার পূর্ব পর্যন্ত প্র-মাতামহী দেলা ফ্রাজিয়ারের তত্ত্বাবধানে তাদের শৈশব কাটিয়েছিল। 

সংবাদ সংস্থা রকডেল নিউজ বলছে, ওই মেয়েরা গার্ল স্কাউটস এবং ভালো ছাত্র ছিল। কিন্তু হাইস্কুলে পড়াকালে তারা একবার তাদের মায়ের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। 

আদালতকে পরে জানানো হয়েছিল, নিক্কি মনে করতেন যে, মেয়েরা মারিজুয়ানা গ্রহণ করছেন এবং স্কুল বাদ দিয়ে যৌনকর্মে সক্রিয় ছিলেন। অন্যদিকে মেয়েরা তাদের মায়ের মনোভাব নিয়ে বিরক্ত ছিলেন। 

 কাউন্টি ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি রিচার্ড পরে আদালত বলেন, তারা মনে করেছিলেন যে, তিনি (মা) একজন শঠ ছিলেন। কারণ তিনি অস্পষ্ট স্বভাবের এবং মারিজুয়ানা গ্রহণ করতেন। 

একদিন মা ও মেয়েদের মধ্যে এই বৈরি সম্পর্কের কারণে তাদের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটল।  সেদিন ছিল ২৮ জুন, ২০০৮। সেদিন ৯১১ নম্বরে ফোন করে পুলিশ অফিসার মায়রা স্ক্রুগসকে তাদের বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। 

স্ক্রুগস ট্রু ক্রাইম ডেইলিকে বলেন, মেয়েদের দেখে খুবই নির্দোষ বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু নিক্কির মুখ দেখে মনে হলো তিনি মেয়েদের কারণে ভীত-সন্ত্রস্ত  ছিলেন। 

মা জারমেকা 'নিক্কি' হোয়াইটহেড

বিষয়টা অমিমাংসিত রেখেই স্ক্রুগস ওই বাড়ি ত্যাগ করেন। কিন্তু এলাকায় রয়ে গেলেন তিনি। কয়েক মিনিটের মধ্যে নিক্কি দ্বিতীয়বার ৯১১ নম্বরে কল করে বলেন যে, তিনি আক্রান্ত হয়েছেন। মেয়েদের  দাবি, তারা তাদের মায়ের  আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। 

স্ক্রুগস বলেন, নিক্কির ঘাড়ে ও বুকে আঁচড়ের দাগ ছিল। তিনি কাঁপছিলেন। কিন্তু অন্যদিকে মেয়েদের গায়ে কোনো ক্ষতচিহ্ন ছিল না।  

রকডেল নিউজ জানায়, একটি যুব আদালত এই জমজ বোনকে  'অবাঞ্ছিত' বলে ঘোষণা দেয়। তাদের দাদী ডেলার হেফাজতে ফেরত পাঠায় এবং মায়ের সঙ্গে কাউন্সিলিংয়ের আদেশ দেয়। 

তারা ডেলার তত্ত্বাবধানে থাকত যতক্ষন না তারা নিজেরাই ফিরে আসেন এবং বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। এরপর একজন বিচারক আবারও তাদেরকে নিক্কির হেফাজতে পাঠা। 

রকডেল নিউজ জানায়, এই সিদ্ধান্তটি  ২০১০ সালের ৫ জানুয়ারী,'যুব আদালতের হলওয়েতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।' জাসমিয়া মন সবচেয়ে বেশি খারাপ ছিল। এরপর আদালতে তিনি নিক্কির সামনেই বললেন ... 'যদি আমাকে আবার তোমার সাথে থাকতে হয়, তবে আমি তোমাকে মেরে ফেলব।'

আর ঘটনার এক সপ্তাহ পরে নিক্কি মারা যান। 

নিক্কি হোয়াইটহেডের হত্যার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ জাস ও তাসের দিকে মনোযোগ দেয়। তারা উভয়ই গ্লাভস পরে ছিলেন এবং একবারও তা খুলেন নি। পুলিশ তাদের হাত ও বাহু দেখাতে বলেছিল, সেখানে উভয়েরেই কামড়ের চিহ্ন ও আঁচড়ের দাগ ছিল। তারা বললেন যে, এই দাগগুলো আগেকার। 

তারপর সেদিনের ঘটনাগুলোর ধীরে ধীরে উন্মোচন করা শুরু করে। যদিও তারা বলেছিলেন যে, তারা হত্যাকাণ্ডের দিনে ১০ মিনিট দেরি করে স্কুলে গিয়েছেন। তারা সেখানে হেঁটে গিয়েছিলেন। কিন্তু নজরদারি ফুটেজ দেখা গেছে, কয়েক ঘন্টা পর অশ্বারোহণে তারা যাত্রা করেছিলেন। 

রকডেল নিউজের রিপোর্ট বলছে, তদন্তকারীরা অপরাধস্থলে ওয়াশিং মেশিনে তাদের রক্তাক্ত জামাকাপড় খুঁজে পেয়েছিলেন। তারা কার্পেটে বিদ্যমান ব্লিচের মাধ্যমে প্রমাণ পেয়েছিলেন, কেউ একজন রক্ত ​​পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছিলেনে। এরপর নিক্কির দাঁতগুলোতে মেয়েদের চুলের একটি অংশ পাওয়া গিয়েছিল। 

টাসমিয়ার বাম বাহুতে কামড়ের চিহ্ন ছিল যা তিনি পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার পথে ঢাকার চেষ্টা করেছিলেন। এর সাথে নিক্কির দাঁতের রিপোর্ট মিলে যায়। 

কিন্তু সব প্রমাণ একত্রিত করার জন্য পুলিশের চার মাস সময় লেগেছিল। এই চার মাস জমজ বোনকে পৃথকভাবে পরিবার ও শিশু পরিষেবা বিভাগের তত্ত্বাবধানে রাখা হয়। 

অবশেষে ২০১০ সালের ২১ মে তারিখে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হত্যা এবং নৃশংস হামলার অভিযোগে অভিযুক্ত হন। 

কিন্তু প্রায় চার বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও তারা বিচারের অপেক্ষায় রয়েছেন। তারা একটি আপিল শুনানী মোকাবেলা করছেন। তারা শেষ পর্যন্ত ওই হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেছেন।

পুলিশ টেপ থেকে জানা গেছে, জসমিয়াহ বর্ণনা করছেন, সেদিন সকালে তারা তাদের মাকে খুন করেছিলেন। তারা সেদিন স্কুলে দেরিতে গিয়েছিলেন। এ বিষয় নিয়ে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করেছিলেন। তারা দাবি করেছিলেন যে, তিনি রান্নাঘরের একটি পাত্র দিয়ে তাদের হুমকি দিয়েছিলেন, যা থেকে বিবাদ চরমে পৌঁছে। 

জাসমিয়া গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে বলেন, তিনি পাত্রটি  ঘুরাতে লাগলেন। তাই আমি মনে করি তিনি আমাদের পাত্র দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করছেন।

তিনি নিক্কির কাছ থেকে পাত্রটি ছিনিয়ে নিতে ধ্বস্তাধস্তি শুরু করেন। এরপর তিনি একটি ছুরি হাতে তুলে নেন। তিনি এটা ব্যবহার করেননি। জাসমিয়া প্রথমে তাকে পাত্রটি দিয়ে আঘাত করে। তারপর তারা একটি পটি দিয়ে তাকে আঘাত করেন। নিকি তখন বাঁচতে মেয়েদের ঘুঁসি মারেন এবং আঁচড় কাটতে থাকেন যতক্ষণ না তাসমিয়া একটি ছুরি দিয়ে আক্রমণ করেছিলেন।
 
তাসমিয়া বলেন, আমি একটি ছুরি হাতে নিয়ে তাকে ছুরিকাঘাত করি। আমি তাকে পেটে একাধিকবার ছুরি মারি। 

জাসমিয়া জানান, এরপর তারা একসঙ্গে তাকে বাথটাবে টেনে নিয়ে যান, যেখানে নিক্কি তার শেষ কথা বলেছিলেন: আমি তোমাদের ঘৃণা করি। ...তোমরা  জেলে যাবে। 

এরপর তারা ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ভ হয়ে যান। 'দীর্ঘ সময় কান্নাকাটি' করে তারা স্থানটি পরিষ্কার করার চেষ্টা করেন। তারপর কাপড় বদল করে স্কুলে যান দুই বোন। 

জাসমিয়া পুলিশের কাছে বলেছেন, আমি তাকে ঘৃণা করতাম না। এমনকি তাসও তাকে ঘৃণা করত না। 

এদিকে, ২০১২ সালে এই দুই জমজ বোনকে ৩০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

সূত্র : এমএসএন নিউজ 

এই বিভাগের আরো খবর