বৃহস্পতিবার   ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫   পৌষ ১০ ১৪৩২   ০৫ রজব ১৪৪৭

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
১৬৫

ফার্মগেটে আবারো মেট্রো দুর্ঘটনা, প্রশ্নবিদ্ধ নিরাপত্তা ব্যবস্থা

রাফিউল ইসলাম তালুকদার

প্রকাশিত: ২৬ অক্টোবর ২০২৫  

এক বছরের ব্যবধানে ঢাকার মেট্রোরেলে একই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটল। রবিবার দুপুরে ফার্মগেট এলাকায় ট্রেন চলাচলের উড়ালপথ থেকে একটি ভারী বিয়ারিং প্যাড খুলে নিচে পড়ে যায়। ওই বস্তু পড়ে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। দুর্ঘটনার পরই মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে আগারগাঁও থেকে উত্তরা পর্যন্ত চলাচল আংশিকভাবে চালু হলেও মতিঝিল অংশে সেবা বন্ধই থাকে।

এর আগে, গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর একই এলাকায় আরেকটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল। তখন কেউ হতাহত না হলেও, ট্রেন চলাচল ১১ ঘণ্টা বন্ধ ছিল। সেই ঘটনার তদন্তে একটি কমিটিও গঠিত হয়েছিল, কিন্তু এক বছর না যেতেই একই ধরণের দুর্ঘটনা আবারো ঘটল—যা এখন যা সংক্লিষ্ট প্রকৌশলীদের বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

বিয়ারিং প্যাড আসলে কী?

মেট্রোরেলের উড়ালপথে প্রতিটি অংশ পিলারের ওপর স্থাপিত। এই সংযোগস্থলেই থাকে বিয়ারিং প্যাড—রাবার ও ইস্পাতের মিশ্রণে তৈরি আয়তাকার স্তর, যা কংক্রিটের ভায়াডাক্ট (উড়ালপথ) ও পিলারের মাঝে বসানো হয়।

এর মূল উদ্দেশ্য হলো ভারসাম্য রক্ষা ও কম্পন শোষণ করা। কারণ, দুটি কংক্রিটের কাঠামো সরাসরি সংযুক্ত হলে ঘর্ষণ ও ক্ষয় সৃষ্টি হয়, যা স্থায়িত্বে প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এই বিয়ারিং প্যাড কুশনের মতো কাজ করে—পুরো স্থাপনাটিকে স্থিতিশীল রাখে।

ডিএমটিসিএলের (ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড) তথ্যমতে, প্রতিটি স্প্যানের নিচে চারটি করে প্যাড থাকে, অর্থাৎ একেকটি পিলারে চারটি রাবার-প্যাড স্তর ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলোর প্রতিটি স্তর বিশেষ রাবার ও স্টিল দিয়ে তৈরি।

 

কেন বারবার খুলে পড়ছে?

প্রকৌশলীরা বলছেন, বিয়ারিং প্যাড নাট-বল্টু দিয়ে আটকানো নয়—এটি নিজের ওজন ও ওপরের কাঠামোর চাপেই স্থির থাকে। তাই একে নিচে পড়ে যাওয়া “খুবই অস্বাভাবিক” ঘটনা।

ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, এটি নকশাগত ত্রুটির ফল হতে পারে। জাপানের এনকেডিএম অ্যাসোসিয়েশন মেট্রোরেলের নকশা ও নির্মাণ তত্ত্বাবধান করেছে। এখন প্রশ্ন উঠছে—জাপানি প্রযুক্তি ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও এমন ত্রুটি কেন থেকে গেল?

দেশীয় বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই দুর্ঘটনা শুধু দুঃখজনক নয়, এটি প্রকৌশলগত প্রশ্নও তোলে। এত দামি প্রকল্পে নিরাপত্তার এমন ব্যর্থতা অগ্রহণযোগ্য। যদি নকশাগত সমস্যা থেকে থাকে, তবে সেটা বের করতে স্বাধীন নিরাপত্তা অডিট জরুরি।

মেট্রোরেল চলাচলের কারণে নিয়মিত কম্পন তৈরি হয়। যেখানে বোল্ট ব্যবহৃত হয়েছে, সেখানে সময়ে সময়ে পরিদর্শন বাধ্যতামূলক। কিন্তু এখানে যে বেয়ারিং প্যাডগুলো শুধুই চাপে নির্ভর করছে, সেখানে সুরক্ষা ব্যবস্থা বাড়ানো দরকার ছিল।

 

দুর্ঘটনার স্থান ও তদন্ত

ডিএমটিসিএলের তথ্যমতে, গত বছর যে পিলার থেকে বিয়ারিং পড়েছিল, সেটি ছিল ৪৩০ নম্বর পিলার। এবারের দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪৩৩ নম্বর পিলারে, যা ফার্মগেট স্টেশনের পশ্চিম পাশে। অর্থাৎ, দুই ঘটনাস্থল কাছাকাছি হলেও অভিন্ন নয়।

মেট্রোরেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ বলেছেন, “তদন্তে নকশা, নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, সব দিকই খতিয়ে দেখা হবে। কারও অবহেলা থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

এদিকে সেতু মন্ত্রণালয় পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তারা খতিয়ে দেখবে, ঘটনাটি নাশকতা, নাকি নির্মাণজনিত ত্রুটির ফল।


 

মেট্রোরেলের গুরুত্ব ও প্রভাব

ঢাকার মেট্রোরেল এখন প্রতিদিন প্রায় সাড়ে চার লাখ যাত্রী বহন করে। সকাল ৬টা ৩০ মিনিট থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলাচল করে এই পরিবহন। তাই একে বন্ধ রাখতে হলে রাজধানীর যানজটে ব্যাপক প্রভাব পড়ে।

২০২২ সালের ডিসেম্বরেই বাংলাদেশে মেট্রোরেলের যাত্রা শুরু হয়। শুরুতে এটি চলত উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত, পরে পর্যায়ক্রমে মতিঝিল পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। বর্তমানে কমলাপুর পর্যন্ত কাজ চলছে।

প্রকল্পটির প্রাথমিক ব্যয় ছিল ২১,৯৮৫ কোটি টাকা, যা পরে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩,৪৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১৯,৭১৮ কোটি টাকা। প্রতি কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণে প্রায় ১,৫০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। অনেকেই মনে করেন, এই ধরনের ঘটনা মেট্রোরেল নিয়ে মানুষের ইতিবাচক ধারণায় আঘাত হানবে। এখনই সঠিক তদন্ত ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি।

চলমান তদন্তের ফলাফল না আসা পর্যন্ত, ঢাকাবাসী একটাই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে, সবচেয়ে নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থারই যদি এমন নিরাপত্তাঝুঁকি থাকে, তাহলে কোথায় ভরসা খুঁজবে সাধারণ মানুষ?

এই বিভাগের আরো খবর