মঙ্গলবার   ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫   আশ্বিন ৭ ১৪৩২   ৩০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
৩৭

বাতিল হতে পারে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ৩ ও ৫ ধারা

তরুণ কণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫  

সংবিধান ও তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ‘দ্য অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট-১৯২৩’ প্রয়োজনীয় সংশোধনসহ হালনাগাদের উদ্যোগ নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মূলত জনপ্রশাসন সংস্কারবিষয়ক কমিশনের সুপারিশের আলোকে শতবছরের পুরোনো এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার পথের ‘কাঁটা’ হিসেবে পরিচিত এ আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজিতে লেখা আইনটির বাংলায় লিখিত রূপ দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছে দায়িত্বশীল একটি সূত্র।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, স্বাধীন সাংবাদিকতা নিশ্চিত করতে ইংরেজিতে লেখা আইনটি সংশোধন করে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার বিষয়ক কমিশন। এ আইন নিয়ে দেশে বহু বিতর্ক রয়েছে। আইনটির ৩ ও ৫ ধারা দুটি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হয়। সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা বারবার এ আইনের দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু অতীতের সরকারগুলো আইনটি সংশোধনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এটি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অপব্যবহার হয়েছে। আওয়ামী লীগ শাসনামলে দেশের বহুল পঠিত একটি সংবাদপত্রের একজন নারী সাংবাদিককে এ আইনের ৩ ও ৫ ধারায় ‘গুপ্তচরবৃত্তি’ ও ‘রাষ্ট্রীয় গোপন নথি নিজের দখলে রাখা’র অভিযোগে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ কর্মকর্তা জানান, অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ধারা অনুযায়ী অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড। আর ৫ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড অথবা ১৪ বছরের কারাদণ্ড। তবে বিচারক চাইলে সর্বনিম্ন সাজা ৩ বছরও দিতে পারেন।

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, বিতর্কিত ৩ ও ৫ ধারায় বড় ধরনের সংশোধনী আনা হবে। এমনও হতে পারে, ধারা দুটি বাতিল হবে। কারণ ধারা দুটি নিয়ে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে তীব্র আপত্তি আছে। এটি বিবেচনায় নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সংবিধানের ৩৯ ধারা এবং তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট সংশোধন ও হালনাগাদ করতে একজন আইন ও বিধি পরামর্শক নিয়োগ দিতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে জননিরাপত্তা বিভাগ। নিয়োগের জন্য প্রাপ্ত আবেদনপত্রগুলো যাছাই-বাছাই শেষে সুপারিশ ও নিয়োগ চূড়ান্ত করতে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। কমিটির সভাপতি করা হয়েছে জননিরাপত্তা বিভাগের আইন ও শৃঙ্খলা অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে। এ ছাড়া যুগ্ম সচিব (আইন), উপসচিব (প্রশাসন-২) এবং গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলীকে (ইডেন ভবন) কমিটির সদস্য করা হয়েছে। আর সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন জননিরাপত্তা বিভাগের সহকারী সচিব (আইন-২)।

জনপ্রশাসন বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার উন্মুক্ত তথ্য নীতি গ্রহণের কথা বিবেচনা করতে পারে। কারণ সরকারি তথ্য উন্মুক্ত করলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধি পাবে এবং তা দুর্নীতি লাঘবে সহায়ক হবে। এজন্য তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট-১৯২৩ এবং সাক্ষ্য আইন-১৮৭২ প্রয়োজনীয় সংশোধন করে যুগোপযোগী করা যেতে পারে। সংবাদপত্র ও অন্যান্য মিডিয়ার নিরপেক্ষ, সত্যান্বেষী, বস্তুনিষ্ঠ, দায়িত্বশীল সংবাদ এবং মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সাংবাদিকদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য উৎসাহ দিতে হবে বলেও মতামত দেয় জনপ্রশাসন বিষয়ক সংস্কার কমিশন।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে ১৯২৩ সালের ২ এপ্রিল ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ আইনটি প্রণয়ন করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ৩০ জুন ‘দ্য বাংলাদেশ ল’জ (রিভিশন অ্যান্ড ডিক্লারেশন) অ্যাক্টের দ্বিতীয় তপশিলে দুটি শব্দ পরিবর্তন করে সরকারি গোপনীয়তা সংক্রান্ত ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ আইনটি আত্তীকরণ করে বাংলাদেশ।

আইন বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, ২০০৯ সালে তথ্য অধিকার আইন প্রণীত হওয়ার পর ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া শতবর্ষের পুরোনো অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের কার্যকারিতা আর নেই। কারণ নতুন আইন সব সময়ই অগ্রাধিকার পাবে। তবু রাষ্ট্রযন্ত্র আইনটির অপব্যবহার করে আসছে। বিশেষ করে সাংবাদিকদের ওপরই এ আইনের অপব্যবহার সবচেয়ে বেশি হয়েছে।

তারা আরও বলেন, ১৯২৩ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে শাসকদের বিবেচনায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি রোধে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রণীত দেশের সংবিধানের ৩৯ ধারায় মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ফলে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ও ৫ নম্বর ধারা সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও মানুষের জানার অধিকার নিশ্চিত করতে ব্রিটিশদের আইনটিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলেও মনে করছেন আইন বিশ্লেষকরা।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ কালবেলাকে বলেন, ‘ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশ শাসনের সময় সারা বিশ্ব নানাভাবে যুদ্ধবিগ্রহে যুক্ত ছিল। তখন তারা তাদের উপনিবেশ টিকিয়ে রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় অনেক বিষয় গোপন রাখার প্রয়োজন অনুভব করেছিল বলেই আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল। এটি তখন দরকারও ছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের সংবিধানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রদান এবং তথ্য অধিকার আইনে জনগণের তথ্য পাওয়ার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। অথচ অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে তথ্য গোপন রাখার সংস্কৃতি চালু আছে। যা সংবিধান ও তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে একেবারেই সাংঘর্ষিক।’

এই আইনজ্ঞ আরও বলেন, ‘প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে গ্রেপ্তার ও কারাগারে পাঠানো হয়েছিল এই আইনের অধীনেই। ফলে স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে এক ধরনের কাঁটা হিসেবে বিবেচিত হতে থাকল অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট। বর্তমান বিশ্বে সাংবাদিকতার ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে। বাংলাদেশেও অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিতের জন্য ব্রিটিশদের আইনটি সংশোধন প্রয়োজন। তবে যেন আগের বিতর্কিত ধারাগুলো আবার অন্য কোনো ফরমেটে আইনে না ঢুকানো হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে।’ শুধু রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয়গুলো গোপন রাখার বিধান রেখে অন্য ক্ষেত্রে যেন সবাই তথ্য পায় সে বিষয়টি সংশোধিত আইনে রাখা খুবই জরুরি বলে মনে করেন মনজিল মোরসেদ।

বিতর্কিত ও সমালোচিত এই আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, নিষিদ্ধ স্থানে যদি কেউ যায় বা যেতে উদ্যত হয় কিংবা ওই স্থানের কোনো নকশা বা স্কেচ তৈরি করে বা কোনো গোপন তথ্য সংগ্রহ বা প্রকাশ করে, তবে সে অপরাধী হবে। ৩ (ক)-তে বলা হয়েছে, নিষিদ্ধ স্থানের কোনো ফটো, স্কেচ বা নকশা কেউ প্রকাশ করতে পারবে না। ৩ (১) ধারায় গুপ্তচরবৃত্তির শাস্তির কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা অথবা স্বার্থের পরিপন্থি কোনো উদ্দেশ্যে নিষিদ্ধ এলাকায় গমন করে, শত্রুপক্ষের উপকারে আসার মতো কোনো স্কেচ. প্ল্যান, মডেল অথবা নোট তৈরি করে কিংবা কোনো অফিসিয়াল গোপন কোড অথবা পাসওয়ার্ড অথবা নোট অথবা অন্য কোনো দলিলপত্র অথবা তথ্য আহরণ করে, রেকর্ড করে, প্রকাশ করে অথবা অন্য কোনো ব্যক্তির কাছে পাচার করে, তবে সে এই ধারার অপরাধে অপরাধী হবেন।

৩(২) ধারায় রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্বার্থের পরিপন্থিমূলক কাজ এবং ৩ (৩) (ক) ধারায় অপরাধটি বিদেশি শক্তির স্বার্থে বা প্রয়োজনে করা হয়েছে বলে ধারণা করা গেলে বা প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড বা ১৪ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে অনধিক তিন বছর কারাদণ্ড। আইনের ৫ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো নিষিদ্ধ এলাকা ও সরকার ঘোষিত কোনো এলাকা সম্পর্কীয় কোনো গোপনীয় অফিসিয়াল কোড বা পাসওয়ার্ড বা কোনো স্কেচ, প্ল্যান, মডেল, আর্টিক্যাল, নোট, দলিলপত্র অথবা তথ্য কোনো ব্যক্তি আইনসংগত দখলে বা নিয়ন্ত্রণে রেখেও যদি যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন না করে, যদি অন্য কোনো ব্যক্তির নিকট হস্তান্তর করে, তার নিয়ন্ত্রণাধীন তথ্যাদি অন্য কোনো বিদেশি রাষ্ট্র ব্যবহার করে, তাতে সেই ব্যক্তি অপরাধী হবে। ৫ (ক) উপধারা অনুযায়ী কোনো প্রতিরক্ষা নির্মাণকাজ, অস্ত্রাগার, নৌ, স্থল বা বিমানবাহিনীর স্থাপনা বা স্টেশন বা খনি, মাইনক্ষেত্র, কারখানা, ডকইয়ার্ড, ক্যাম্প বা বিমান বা গোপনীয় অফিসিয়াল কোড সংক্রান্ত অপরাধে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা ১৪ বছর কারাদণ্ড। অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে দুই বছর কারাদণ্ড।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকার সংগঠন ল অ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশনের সভাপতি ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ন কবির পল্লব কালবেলাকে বলেন, ‘সরকারি তথ্য গোপন রাখা নয় বরং রাষ্ট্রের নাগরিকদের অবাধ তথ্য প্রাপ্তির সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট বিকাশমান তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে সংগতি রেখে সংশোধন করতে হবে। ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে হবে। সরকারি গোপনীয় তথ্যের সংজ্ঞায়নে অযৌক্তিকভাবে নাগরিকের তথ্যপ্রাপ্তির মৌলিক অধিকারকে কোনোভাবেই সংকুচিত করা যাবে না। বিশেষ করে বর্তমান আইনের ৩ ও ৫ ধারায় গণমাধ্যম কর্মীদের তথ্য প্রাপ্তির বাধাগুলো দূর করতে হবে, যাতে সংবাদকর্মীরা নির্ভয়ে জনস্বার্থে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করতে পারেন।’

এই বিভাগের আরো খবর