সোমবার   ০৩ নভেম্বর ২০২৫   কার্তিক ১৮ ১৪৩২   ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
৪৮

পুড়ছে পশ্চিম তীর, ফিলিস্তিনি কৃষকদের জীবিকায় ইসরায়েলের রক্তচক্ষু

রাফিউল ইসলাম তালুকদার

প্রকাশিত: ২ নভেম্বর ২০২৫  

দখলকৃত পশ্চিম তীরে জলপাই সংগ্রহের মৌসুম শুরু হয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে ইসরায়েলিদের অব্যাহত হামলা, ফিলিস্তিনি কৃষকদের ওপর, তাদের ফসলের ওপর, তাদের জীবিকার ওপর।

 

২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর ৭৫৭টি বসতকারী হামলার ঘটনা রেকর্ড করেছে, যেগুলোতে মানুষ আহত হয়েছে বা সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্য করে আক্রমণ, অলিভ বাগান পুড়িয়ে দেওয়া এবং ফসল নষ্টের ঘটনায় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল থেকে তীব্র নিন্দা এসেছে।

 

গাজায়, যেখানে একসময় নিজস্ব অলিভ শিল্প ছিল, সেখানে ইসরায়েলের দুই বছরের অভিযানে প্রায় সব কৃষিজমিই ধ্বংস হয়েছে। নিহত হয়েছে ৬৮,০০০-রও বেশি ফিলিস্তিনি।

 

 

কেন অলিভ চাষ ফিলিস্তিনিদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?

অলিভ বা জলপাই চাষ ফিলিস্তিনের সবচেয়ে বৃহৎ কৃষি কার্যক্রম, যার ইতিহাস কয়েক হাজার বছর পেছনে, ভূমধ্যসাগরীয় সভ্যতার সময় পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রাচীন গ্রিকরা যেমন জলপাইয়ের শাখাকে শান্তির প্রতীক হিসেবে দেখত, তেমনি ফিলিস্তিনিদের কাছেও এই গাছ আজও ঐতিহ্য, ইতিহাস ও অস্তিত্বের প্রতীক। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ফিলিস্তিনে জলপাই ব্যবহৃত হয়েছে খাদ্য, ঔষধ, প্রসাধনী, সাবান এবং জ্বালানি তৈরিতে। এমনকি এর কাঠও ব্যবহৃত হয় নির্মাণ কাজে। অটোমান শাসনের চারশ বছরের সময়কাল (১৭শ থেকে ২০শ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত) ফিলিস্তিনে জলপাই  উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়, এবং অলিভ বাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি খাতে পরিণত হয়।

 

এখনো দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের প্রায় অর্ধেক কৃষিজমিতে অলিভ চাষ হয়। প্যালিস্টেনিয়ান ট্রেড সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, বছরে এই ফসল থেকে ফিলিস্তিনি অর্থনীতিতে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার প্রবাহিত হয়। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিম তীরে প্রায় ১ লক্ষ পরিবার তাদের জীবিকা চালায় জলপাই মৌসুমের আয়ে, এর মধ্যে প্রায় ১৫ শতাংশ নারী শ্রমিক। জলপাই চাষ ফিলিস্তিনিদের কাছে শুধু কৃষি নয়, এটি তাদের অস্তিত্ব ও প্রতিরোধের প্রতীকও বটে। অলিভ গাছ ফিলিস্তিনি সমাজে ‘সুমুদ’ বা অবিচল প্রতিরোধের প্রতীক, যা সম্প্রতি গাজাগামী মানবিক সহায়তা বহরের নামেও ব্যবহৃত হয়েছে।

 

 

পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি কৃষকদের সাথে কী ঘটছে?

ব্রিটিশ আমল থেকে অদ্যাবধি ফিলিস্তিনি কৃষি, বিশেষ করে জলপাই বাগান নিয়মিতভাবে জায়নিস্ট দখলদারদের হামলার শিকার হয়েছে। বর্তমানে পশ্চিম তীরে ১৫০টি বসতি ও ২০০টি আউটপোস্টে প্রায় ৭ লক্ষ ইসরায়েলি বাস করছে । আন্তর্জাতিক আইনে এগুলো অবৈধ। এমনকি ইসরায়েলি আইনে অবৈধ ঘোষিত আউটপোস্টগুলোও কোন বাঁধার সম্মুখীন হয়না। ২৫ মে ২০২৫-এ নাবলুসের পূর্বে সালেম গ্রামে একটি জলপাই বাগান আগুনের লেলিহান শিখায় ধ্বংস হয়ে যায় , ইসরায়েলি অবৈধ বাসিন্দারা এই আগুন লাগিয়েছে বলে দাবি স্থানীয় ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের।

 

২০২৩-এর ৭ অক্টোবর  হামাসের নেতৃত্বে প্রতিরোধ শুরু হওয়ার ঠিক আগে পশ্চিম তীরজুড়ে ফিলিস্তিনি কৃষকদের ওপর সহিংসতা বাড়ছিল। ২০২০ সালের এক জরিপে দেখা যায়, আগের বছরেই প্রায় ৪০ শতাংশ ফিলিস্তিনি জলপাই চাষী তাদের ফসল চুরি বা ধ্বংস হওয়ার ঘটনা জানিয়েছিলেন। হামলাগুলোতে অনেক ক্ষেত্রেই ইসরায়েলি সেনারা কিছুই করেনি, বরং অনেক সময় প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছে। জাতিসংঘ জানায়, অন্তত ৩৮টি ঘটনায় সামরিক বাহিনীর সরাসরি ইন্ধন ছিলো। অনেক ক্ষেত্রে সেনারা নিজেরাই ফিলিস্তিনিদের অলিভ গাছ উপড়ে দিয়েছে। আগস্ট ২০২৫-এ, ইসরায়েলি সেনারা আল মুগাইয়ার গ্রামে তিন দিনের অভিযানে ১০,০০০টি অলিভ গাছ ধ্বংস করে, এরমধ্যে কয়েকটি গাছ শত বছরের পুরোনো ছিল।

 

ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম Haaretz-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ইসরায়েলের সামরিক জেনারেল আভি ব্লুথ বলেছিলেন, “প্রতিটি গ্রাম জানবে, যদি তারা কোনো আক্রমণ চালায়, তবে তাদের বড় মূল্য দিতে হবে।”

৭ অক্টোবরের পর পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের যাতায়াতে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এতে অনেক কৃষককে সপ্তাহের কাজ কয়েক দিনের মধ্যে শেষ করতে বলা হয়। ফলে প্রায় ২০ শতাংশ জলপাই সংগ্রহ করা যায়নি। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনের হিসাবে, এতে ফিলিস্তিনি কৃষকদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১ কোটি ডলার। ২০২৪ সালে সহিংসতা বৃদ্ধি পায়, ২০০টির বেশি হামলা রেকর্ড করা হয়, যা আগের বছরের দ্বিগুণ। এর মধ্যে ছিল ৫৯ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি নারী হানান আবু সালামি-র হত্যাকাণ্ড, যাকে ১৭ অক্টোবর ২০২৪-এ ইসরায়েলি সেনারা জেনিনের বাইরে তার নিজের পরিবারের অলিভ বাগানে গুলি করে হত্যা করে। পরবর্তীতে জাতিসংঘের তদন্তে নিশ্চিত হয়, তিনি কোনো ধরনের হুমকি দিচ্ছিলেন না।

 

জলপাই বাগান কেন ইসরায়েলিদের লক্ষবস্তু?

এই আক্রমণগুলো কেবল জলপাই বাগানে নয় ফিলিস্তিনি সমাজের জীবনযাত্রা ও অস্তিত্বের ওপর সরাসরি হামলা। মূল উদ্দেশ্য, ফিলিস্তিনিদের আর্থিকভাবে দুর্বল করা, তাদের জমি ছেড়ে যেতে বাধ্য করা এবং পুরো অঞ্চল দখল করা। ইসরায়েলি সেনা এবং অবৈধ বাসিন্দারা প্রায়ই কূপ ভরাট করে পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, ফিলিস্তিনিদের গবাদি পশু মেরে ফেলে, কৃষিঘর ও খামার ভেঙে দেয়।

 

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন ডানপন্থী সরকার পশ্চিম তীরকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা নিচ্ছে। এ মাসেই সেই সংক্রান্ত একটি প্রাথমিক বিল পাশ হয়েছে। তাছাড়া ইসরায়েলি আইনে অবৈধ ঘোষিত অনেক আউটপোস্টকেও সরকার প্রশ্রয় দিচ্ছে।

 

ইসরায়েলের দুই বছরের অভিযানে গাজার প্রায় ১১ লক্ষ জলপাই গাছ ধ্বংস হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ২০২৫ সালের আগস্টে জানায়, গাজার ৯৮.৫ শতাংশ কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত বা অপ্রবেশযোগ্য। একই মাসে জাতিসংঘ-সমর্থিত বৈশ্বিক ক্ষুধা পর্যবেক্ষক আইপিসি ঘোষণা করে, গাজায় ৫ লাখেরও বেশি মানুষ দুর্ভিক্ষে ভুগছে।

 

মানবাধিকার সংস্থা আল মেজান ইসরায়েলকে “পরিবেশ ধ্বংস” অর্থাৎ ইকোসাইডের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে। তাদের অক্টোবর ২০২৪-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, “বিষাক্ত পদার্থ ধীরে ধীরে মাটিতে মিশে যেতে পারে, যা দ্রবণীয় জৈব পদার্থ, অজৈব উপাদান, ভারী ধাতু এবং অন্যান্য ক্ষতিকর যৌগের মারাত্মক মিশ্রণ তৈরি করবে। এই দূষণ মাটি, কৃষিজমি এবং ভূগর্ভস্থ পানিকে প্রভাবিত করবে, এবং শেষ পর্যন্ত খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করবে।”

 

গাজার প্রায় সব জলাধার, কূপ ও অলিভ প্রেস ধ্বংস হয়ে গেছে। বহু পরিবার এখন জ্বালানির অভাবে শুকিয়ে যাওয়া অলিভ গাছ পুড়িয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছে।

 

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো পশ্চিম তীর ও গাজায় কৃষকদের ওপর হামলার বিষয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ২০২৫ সালের মে মাসে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছিল,  “গাজার উর্বর কৃষিজমি ধ্বংস, যেগুলো খাদ্য উৎপাদনের জন্য অপরিহার্য, এটিকে অবশ্যই যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে অনাহার ব্যবহারের প্রেক্ষাপটে দেখা উচিত।” জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের ফিলিস্তিন প্রধান অজিত সাংঘাই বলেন, “বসতকারীদের সহিংসতা ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর নীরব সমর্থন, সহযোগিতা, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি অংশগ্রহণও রয়েছে এবং সবসময়ই তারা দায়মুক্তি ভোগ করে।”

 

তিনি আরও বলেন: “জলপাইয়ের মৌসুমে এই অব্যাহত হামলাগুলো হলো ইসরায়েলের অসংখ্য আগ্রাসনের মধ্যে একটি, যার লক্ষ্য ফিলিস্তিনিদের তাদের জমি থেকে বিচ্ছিন্ন করা, ভূমি দখল করা, তাদের উচ্ছেদ করা এবং অবৈধ বসতি সম্প্রসারণের পথ সুগম করা।”

 

জলপাই গাছ, যা একসময় ছিল শান্তির প্রতীক, এখন ফিলিস্তিনে টিকে থাকার প্রতীক হয়ে উঠেছে। যে গাছ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ফিলিস্তিনিদের জীবন, শ্রম, ইতিহাস ও মাটির সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল, আজ সেই গাছের প্রতিটি শিকড় ফিলিস্তিনের নিজ ভূমি ধরে রাখার অন্যতম অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই বিভাগের আরো খবর