সোমবার   ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫   ভাদ্র ২৩ ১৪৩২   ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
২৬

সবার ইশতেহারে ঘুরেফিরে পুরোনো প্রতিশ্রুতি, বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব?

তরুণ কণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ইতোমধ্যে ইশতেহার দিয়েছেন বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন সমর্থিত ও স্বতন্ত্র প্যানেলের প্রার্থীরা। শিক্ষার্থীদের মন জয় করতে সবাই নানারকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের অনেকে বলছেন এসব প্রতিশ্রুতি পুরোনো এবং এগুলো বাস্তবায়নে প্রশাসনের ভূমিকাই বেশি, ডাকসুর ভূমিকা কম।

ডাকসু নির্বাচনের ইশতেহারগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্যানেল, ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’, বামপন্থি জোট সমর্থিত ‘প্রতিরোধ পরিষদ’, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’, বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ সমর্থিত ‘ডাকসু ফর চেঞ্জ’ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্যানেল ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ ঘুরে ফিরে প্রায় একইরকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সবাই বলছে ডাকসু ও হল নির্বাচন প্রতিবছর নিশ্চিত করা হবে, শিক্ষার্থীদের সবার জন্য পূর্ণাঙ্গ আবাসন নিশ্চিত করা হবে, নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে ইত্যাদি।

এসব প্রতিশ্রুতির অনেকগুলো ডাকসুর এখতিয়ারভুক্ত নয়, তবুও প্রতিটি প্যানেল সেগুলো বাস্তবায়নের ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি উপস্থাপন করেছে এবং এগুলোতেই জোর দিয়েছে।

শিক্ষার্থীদের অনেকের প্রশ্ন, জয়ী হওয়ার পর প্রার্থীরা ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করতে পারবেন নাকি এটি কেবল ভোটারদের মন জয় করার কৌশল? কারণ, প্রায় একই রকমের প্রতিশ্রুতি সম্বলিত ইশতেহারে ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু পরে ওই নির্বাচিত ডাকসু শিক্ষার্থীদের কল্যাণে তেমন কিছুই করতে পারেনি। সেখানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হয়েছে বেশি।

শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের খাদ্য নিরাপত্তায় ক্যান্টিন ও কাফেটেরিয়া বিষয়ে প্যানেলগুলো নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মধ্যে ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট বলেছে, হল ও ক্যান্টিনে পুষ্টিবিদের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে পুষ্টিকর খাবারের মেন্যু প্রণয়ন করা হবে এবং প্রতি তিন মাস অন্তর খাবারের মান পরীক্ষা করা হবে।

বামপন্থি প্রতিরোধ পরিষদ বলেছে, ব্যক্তিমালিকানাধীন ক্যান্টিনের পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে কাফেটেরিয়া চালু করা হবে। খাবারে অন্তত ৮০০ কিলোক্যালরি নিশ্চিত করা হবে। ভর্তুকি দিয়ে দাম কমানো হবে। থাকবে বৈচিত্র্যময় মেন্যু। রাত ১২টা পর্যন্ত খাবারের ব্যবস্থা রাখা হবে। কলাভবন ও টিএসসি কাফেটেরিয়া সংস্কার করা হবে।

ছাত্রদল ক্যান্টিন ও ক্যাফেটেরিয়ায় ভর্তুকি বাড়ানো, পুষ্টিবিদদের টিম গঠন এবং খাবারের মান ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ টিএসসি ও ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ায় ভর্তুকিযুক্ত খাবার ও নতুন ক্যান্টিন স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

সব প্যানেলই খাবারে ভর্তুকি, মানোন্নয়ন ও নিয়মিত পরীক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলেছে। তবে প্রতিরোধ পরিষদ অতিরিক্ত হিসেবে নির্দিষ্ট ক্যালোরি, রাত অবধি খাবারের ব্যবস্থা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছে।

এর বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও খাবারের মান উন্নয়নে কাজ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

আবাসন

ইশতেহারে আবাসন নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিভিন্ন প্যানেল। প্রথম বর্ষ থেকে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর বৈধ সিট নিশ্চিত করার কথা বলেছে ছাত্রশিবির। বামপন্থিদের প্রতিরোধ পর্ষদ হলে সন্ত্রাস-দখলদারিত্ব বন্ধ, পুরোনো ভবনের সংস্কার, সম্প্রসারণ ও নতুন ভবন নির্মাণে প্রশাসনকে বাধ্য করা, প্রথম বর্ষ থেকেই প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে সিট নিশ্চিত করা, র‍্যাগিং নিষিদ্ধ, ক্যাম্পাস চার্টার প্রকাশ এবং সিসি ক্যামেরা কার্যকর রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাগছাস ‘ওয়ান স্টুডেন্ট ওয়ান সিট’ নীতি বাস্তবায়ন, আবাসন সংকট নিরসনে ভর্তুকি ও এটাচমেন্টের প্রস্তাব করেছে। ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার অংশ হিসেবে নতুন হল নির্মাণ ও ভর্তির দিন থেকেই প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য একটি সিট ও পড়ার টেবিল নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

স্বাস্থ্যসেবা

মেডিকেল সেন্টার আধুনিকায়ন, সার্বক্ষণিক ডাক্তার-অ্যাম্বুলেন্স-ফার্মেসি, বিনামূল্যে জরুরি ঔষধ, হলে মেডিকেল কর্নার, স্বাস্থ্যবিমা, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ছাত্রদল। ছাত্রশিবির মানসিক স্বাস্থ্য ও কাউন্সেলিং সেবা বৃদ্ধি, মেডিকেল সেন্টার আধুনিকীকরণ, DUMC অ্যাপ চালু, নারী চিকিৎসক নিশ্চিতকরণ, বেসরকারি হাসপাতালে ছাড়, স্বাস্থ্যবিমার ভোগান্তি নিরসন, হলভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি চালুর প্রস্তাব করেছে। প্রতিরোধ পরিষদ মেডিকেল সেন্টারকে ন্যূনতম ১০০ শয্যায় উন্নীত করার অঙ্গীকার করেছে। বাগছাস শুধু স্বাস্থ্যবিমা ও মেডিকেল সেন্টার আধুনিকায়নের বিষয়টি উল্লেখ করেছে।

নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা

প্রায় সব প্যানেল নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। ছাত্রদল নারী শিক্ষার্থীদের পোশাকের স্বাধীনতা, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ, স্যানিটারি প্যাড ভেন্ডিং মেশিন, নারী চিকিৎসক, সান্ধ্য আইন বিলোপ ও রাত্রিযাপনের স্বাধীনতার কথা বলেছে। ছাত্রশিবির নিরাপদ পরিবহন, ছাত্রী হলে প্রবেশাধিকার শিথিল, মাতৃত্বকালীন ছুটি, কমনরুমে নারী কর্মচারী নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাগছাস নারী শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার সুযোগ, ২৪ ঘণ্টা অ্যাম্বুলেন্স, নামাজের স্থান প্রসার, অনাবাসিক নারীদের প্রবেশাধিকার ও নারীবান্ধব জনপরিসরের প্রস্তাব করেছে। প্রতিরোধ পর্ষদ নারী শিক্ষার্থীদের সাইবার সুরক্ষা, চলাফেরার স্বাধীনতা, যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল কার্যকরসহ গর্ভবতী শিক্ষার্থীদের জন্য কেয়ার সেন্টার ও ব্রেস্টফিডিং কর্নার, লোকাল গার্ডিয়ান নীতি বাতিল এবং হলে আবাসিক-অনাবাসিক নারীদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

ডাকসু কী করতে পারে বা পারে না

ডাকসু সংবিধান অনুযায়ী এর দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে কমন রুম বজায় রাখা, ইনডোর গেমসের ব্যবস্থা করা, জার্নাল ও ম্যাগাজিন প্রকাশ করা, বিতর্ক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, বক্তৃতা ও সামাজিক সমাবেশ আয়োজন করা। ডাকসুর আরেকটি দায়িত্ব হলো বক্তব্য, পোস্টার-ফেস্টুন প্রদর্শনী ও প্রদর্শনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক সেবার মানসিকতা গড়ে তোলা।

তবে প্যানেলগুলোর ইশতেহার বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, ঢাবি শিক্ষার্থীরা যেসব সমস্যা নিয়ে সব সময় অভিযোগ করে আসছেন সেগুলোই ইশতেহারে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন প্রার্থীরা। যেমন, সবার ইশতেহারেই এসেছে শিক্ষার্থীদের আবাসন ও স্বাস্থ্যসেবা ইস্যু। কিন্তু এ দুটি বিষয় মূলত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এখতিয়ারভুক্ত, ডাকসুর নয়।

দেখা গেছে, উল্লেখযোগ্যভাবে, কোনো প্যানেলই তাদের ইশতেহারে বিতর্ক আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দেয়নি—যা ডাকসুর মূল দায়িত্বগুলোর একটি। যদিও কেউ কেউ সেমিনার, কর্মশালা, গবেষণা কার্যক্রম ও ক্যারিয়ার ফেস্টের অঙ্গীকার করেছে।

ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রার্থীরা শিক্ষার্থীদের দাবি ও কর্মপরিকল্পনাগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তুলে ধরতে পারে, তা বাস্তবায়নের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তবে তা বাস্তবায়ন অনেকটাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে।

এই বিভাগের আরো খবর