মঙ্গলবার   ১৫ জুলাই ২০২৫   আষাঢ় ৩০ ১৪৩২   ১৯ মুহররম ১৪৪৭

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
৩৭

শাকিব খান কি আসলেই মেগাস্টার?

সুমন হোসাইন 

প্রকাশিত: ১৪ জুলাই ২০২৫  

কিছুদিন আগে ছোট পর্দার বড় তারকা জাহিদ হাসান তার এক মন্তব্যে ‘মেগাস্টার’ শব্দ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন। এই শব্দটি কানে লাগে বলেও উল্লেখ করেছিলেন তিনি। আর তার পরেই কেউ কেউ এই অভিনেতাকে নিয়ে কটু মন্তব্য করেন এবং যা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে চলে তোলপাড়। আসলে কী হয়েছিল? 

এবার ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত আলোচিত সিনেমা ‘তাণ্ডব’কে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় জাহিদ হাসান অভিনীত ‘উৎসব’ সিনেমা।


এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়েই এক সাক্ষাৎকারে জাহিদ হাসান মন্তব্য করেন, ‘তাণ্ডব সিনেমাটিকে আলাদা ধরা হয় শাকিব খানের জন্য। শাকিব খানকে বলা হয় মেগাস্টার শাকিব খান। আর অন্য সবাইকে বলা হয় চিত্রনায়ক। কেন, এটা বুঝি না।

সে তো একজন অভিনেতা। তাকে আগেই একটা ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয় কেন। এটা তার জন্য কতটা ভালো হচ্ছে বা মন্দ হচ্ছে জানি না। তবে শব্দটা কানে লাগে।

’ এমন মন্তব্যের পরই এই অভিনেতার ওপর ক্ষিপ্ত হন শাকিব ভক্তরা। 
‘মেগাস্টার’ মানে কী? 

শোবিজ অঙ্গনে একটা শব্দটা বহু আগে থেকেই প্রচলিত, সেটা হচ্ছে ‘তারকা’। কোনো অভিনয়শিল্পী যখন সাধারণের থেকে আলাদা হয়ে ওঠেন, তাঁর অভিনয় দর্শকদের হৃদয়ে দাগ কাটে, তখনই তাঁকে ‘তারকা’ বলা হয়। এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই তারকাদের শ্রেণিবিন্যাস শুরু হয়—কেউ ‘স্টার’, কেউ ‘সুপারস্টার’ আর কেউ বা হয়ে ওঠেন ‘মেগাস্টার’। মেগাস্টার শব্দটি ব্যবহার করা হয় সেসব বিখ্যাত ব্যক্তিদের বোঝাতে, যারা ‘সুপারস্টার’ এর চেয়েও অনেক ওপরে এবং অনেক বেশি প্রভাবশালী।


একজন সুপারস্টারের জনপ্রিয়তা তার নিজ দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও মেগাস্টারের জনপ্রিয়তা শুধু দেশেই সীমাবদ্ধ নয়, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বমঞ্চেও। একজন অভিনেতা যাকে তার সিনেমা বা কর্ম দিয়ে চেনে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ। যার সিনেমা রিলিজ হলে শুধু ঢাকা বা চট্টগ্রাম নয়, প্যারিস বা দুবাইয়ের ভাষাভাষীর দর্শকের কাছেও হাউসফুল হয়। দেশের বাইরেও যখন কেউ বিশাল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন, তখনই তিনি হয়ে ওঠেন ‘মেগাস্টার’। 

তবে শুধু অভিনয় দিয়েই মেগাস্টার হওয়া যায় না, লাগে ভালো ব্র্যান্ডিং, আন্তর্জাতিক প্রজেক্টে অংশগ্রহণ এবং গ্লোবাল ফ্যান কন্টেন্ট। শুধু আন্তর্জাতিক ফ্যানবেস নয়—এর সঙ্গে জড়িত থাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, বৈশ্বিক ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হওয়া, বিদেশি ছবিতে কাজ, কিংবা বিশ্বের বড় বড় মঞ্চে সম্মাননা পাওয়া।

উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে হলিউড, বলিউড কিংবা টলিউডকে। ‘সুপারস্টার’ শব্দটা প্রথমে শোনা যায় হলিউডে। ষাট-সত্তরের দশকে, যখন কেউ একের পর এক ব্লকবাস্টার সিনেমা দিচ্ছিলেন, তখন মার্কিন সাংবাদিকেরা তাঁদের ‘সুপারস্টার’ বলতে শুরু করে। ভারতীয় প্রেক্ষাপটেও এই শব্দটা জনপ্রিয় হয়ে যায় রজনীকান্ত, অমিতাভ বচ্চন বা শাহরুখ খানের মতো অভিনেতাদের মাধ্যমে।

হলিউডে এখন পর্যন্ত কাউকে মেগাস্টার বলতে শোনা যায়নি। তেলুগু সিনেমার কিংবদন্তি চিরঞ্জীবীকে ‘মেগাস্টার’ বলা হয়, এরপর রজনীকান্ত, বিজয় থালাপতি, আল্লু অর্জুন, প্রভাস, জুনিয়র এনটিআরকে বলা হয় সুপারস্টার। বলিউডের শাহরুখ খানকে বলা হয় গ্লোবাল স্টার, তার বিশ্বব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে। সেদিক থেকে টালিডের দেব হোক কিংবা জিৎ; দুজনেই তাদের ইন্ডাস্ট্রির বড় তারকা যাদের সিনেমা শুধু উৎসবেই নয়, বছর জুড়েও চলে। তাদেরকেও দর্শকেরা সুপারস্টার বলে থাকেন। হলিউড, বলিউড হোক আর টলিউড হোক; সেখানে কোনো নায়কের ‘তকমা’ নিয়ে এতটা আহাজারি নেই যতটা দেখা যায় ঢালিউডে।

সাম্প্রতিক সময়ে ঢালিউডের শাকিব খানের নামের আগে উল্লেখ করা হচ্ছে ‘মেগাস্টার’, হোক সেটা সিনেমার পোস্টার, হোক সিনেমার এন্ট্রি কিংবা কারো মন্তব্যে। ভক্তরা ভালোবেসে বলতেই পারেন, কিন্তু শিল্পী থেকে নির্মাতা তার নামের আগে এত পরিমাণে শব্দটি উচ্চারণ করেন এবং শব্দটি এত বেশি পরিমাণে ব্যবহৃত হচ্ছে যার কারণে এখন এটা অনেকেরই ‘কানে লাগে’। সিনেমা সংশ্লিষ্ট অনেকের মতে, শাকিব খান পরোক্ষভাবে শব্দটির প্রমোট করেন। সিনেমার পোস্টার থেকে শুরু করে, এন্ট্রির সময়ে তার নামের আগে মেগাস্টার লিখতে নির্মাতাদেরকে বলে থাকেন এই নায়ক। অনেকেরই প্রশ্ন, শাকিব খান কি আসলেই মেগাস্টার? 

চলচ্চিত্র নির্মাতা রায়হান রাফী মনে করেন, শাকিব খানের জন্য মেগাস্টার শব্দটি শতভাগ যথাযথ এবং যৌক্তিক। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন নায়কের দীর্ঘ ক্যারিয়ার আর তার প্রতি ভক্তদের ভালোবাসা। 

শব্দটির সংজ্ঞায়ন নিয়ে কিছু না বললেও তিনি শুধু বলেন, আমার মনে হয়, এই প্রশ্নের উত্তরটা ভালো দিতে পারবেন, সিনিয়র কোনো শিল্পী বা পরিচালক যারা অনেক মানুষকে দেখেছেন। এখন আমার কাছে তো তিনি (শাকিব) সেরকমই। কারণ, আমার ক্যারিয়ারে আমি তার চেয়ে বড় কাউকে দেখিনি। আমি যদি আরো এক্সপিরিয়েন্স করতে পারতাম তাহলে হয়তো পার্থক্যটা বুঝতে পারতাম।    

এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এই নির্মাতা বলেন, ‘বাহিরের দেশে অনেক স্টার, সুপারস্টার আছে যেখানে নির্মাতা এবং হল মালিকদের কাছে অপশন থাকছে। কখনো আল্লু অর্জুন, কখনো প্রভাস কিংবা কখনো রণবীর কাপুর, শাহরুখ, সালমান, আমির খান; কিন্তু আমাদের দেশে এই সুযোগটা খুবই কম। শাকিব খান তার ক্যারিয়ারের ২৬ বছর পার করেছে, এখনও নতুন নতুন কাজ করে যাচ্ছে। লাস্টলি তার ছবি সবচেয়ে বেশি চলছে। আমার জায়গা থেকে মনে হয়, এটা যৌক্তিক এবং মানুষ ভালোবেসে তাকে এটা বলে। এরকম জায়গায় তো আমাদের দেশে আর কেউ যেতে পারেনি এখনো।’

সেইসঙ্গে যোগ করে তিনি এও বলেন, ‘আমরা যে পোস্টারে তার আগে মেগাস্টার লিখি, এটা তার সম্মানার্থে লিখি।’ 

তবে চলচ্চিত্র বিশ্লেষক ও গুণী নির্মাতা মতিন রহমানের প্রশ্ন, এই শব্দটি কি শাকিব খান নিজে বলছেন নাকি কাউকে দিয়ে বলাচ্ছেন? যদি এরকম হয়ে থাকে তাহলে সে এখনো নিজেকে মূল্যায়ন করতে শিখেনি। এই শব্দটির অর্থই সে মূল্যায়ন করতে পারেনি। যেখানে স্টারই নেই, সেখানে মেগাস্টার হয় কীভাবে? কার ভেতরে সে মেগা? মেগা হতে গেলে তো ইন্ডাস্ট্রিতে আরও দশজন লাগবে। এটা এখন বানানো টাইটেল। অনেক সময় ভক্তরা অনেক কিছু বলে যেখানে স্টারদেরও কিছু করার থাকে না। 

এই প্রবীণ চলচ্চিত্র নির্মাতা বলেন, ‘আমার এখনও মনে আছে, রাজ্জাক সাহেবের যখন শততম ছবি রিলিজ হলো তখন চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির সবাইকে নিয়ে তিনি একটা অনুষ্ঠান করেছিলেন। সেখানে শিল্পী থেকে শুরু করে সাংবাদিক সবাই ছিলেন, আমিও ছিলাম। সেসময় বক্তৃতার এক পর্যায়ে সাংবাদিক আহমেদ জামান চৌধুরী একটা উপাধি দিলেন ‘নায়ক রাজ’। এমন না যে তিনি সেটা জোর করে দিয়েছেন। এরপর থেকে পত্র-পত্রিকায় তার নামের আগে লেখা হতো নায়ক রাজ রাজ্জাক, এটা চলতেই থাকলো। কিন্তু এখন কেউ যদি জোর করে আদায় করে তাহলে সেটা নিয়ে তো প্রশ্ন থাকবেই! আমি যতদূর জানি, বাংলাদেশে আরেকজন নায়ক ছিল যিনি নিজেই তার নামের আগে এই ‘মেগাস্টার’ শব্দটি লিখতে বলতেন এবং তিনি নিজেই এই শব্দটির প্রমোট করতেন।’

এই বিভাগের আরো খবর