সোমবার   ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫   ভাদ্র ২৩ ১৪৩২   ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
১৫

ছাত্রদল গড়বে নিরাপদ ক্যাম্পাস, গেস্টরুম বন্ধে দৃঢ় শিবির

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে ৯ সেপ্টেম্বর। ভোট ঘিরে শেষ দিনের প্রচারে রোববার (৭ সেপ্টেম্বর) ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন প্রার্থীরা। আর যোগ্য নেতৃত্বের খোঁজে তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ও ঘোষিত ইশতেহার খুঁটিয়ে দেখছেন শিক্ষার্থীরা।

এবার নির্বাচনে ১১টি প্যানেল থেকে লড়ছেন ৪৭১ প্রার্থী। যেখানে সবচেয়ে আলোচিত পদ সহ-সভাপতি বা ভিপি। এ পদে সবার নজর ছাত্রদলের আবিদুল ইসলাম খান ও ছাত্রশিবিরের সাদিক কায়েমের দিকে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনকালে জোটবদ্ধ থাকলেও সম্প্রতি ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ হয়ে উঠেছে ছাত্র সংগঠন দুটি। দুই সংগঠনের নেতারা ডাকসু ইস্যুতেও মুখোমুখি অবস্থানে আছেন।

এ ছাড়া ভিপি প্রার্থী পদে স্বতন্ত্র ঐক্যের উমামা ফাতেমা, ছাত্র অধিকার পরিষদের বিন ইয়ামীন মোল্লা, বামজোট সমর্থিত প্রতিরোধ পর্ষদের শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থী শামীম হোসেন বেশ আলোচনায় রয়েছেন।

নির্বাচনে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের নেতৃত্বে আবিদ-হামীম-মায়েদ এবং ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের নেতৃত্বে সাদিক-ফরহাদ-মহিউদ্দিন রয়েছেন। পূর্ণ প্যানেল দেওয়া এ দুটি সংগঠনই নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে। তাতে জয়ী হয়ে ডাকসুর কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করলে আগামীতে তারা শিক্ষার্থীদের জন্য কী কী করবেন, তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।


ছাত্রদল তাদের ইশতেহারে আধুনিক, বসবাসযোগ্য, আনন্দময় ও নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আর ছাত্রশিবিরের প্রতিশ্রুতি ফ্যাসিবাদমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করার পাশাপাশি গেস্টরুম-গণরুম সংস্কৃতির অবসান ঘটানো।

ছাত্রদলের ১০ দফা ইশতেহার:

১. শিক্ষা ও গবেষণাকে প্রাধান্য দিয়ে আধুনিক, আনন্দময়, বসবাসযোগ্য, ও নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তোলা।

২. নারী শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি।

৩. শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য বিমা নিশ্চিত এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাগ্রহণ ও চলাচল সহজতর করা।

৪. পাঠ্যক্রম, অবকাঠামো ও পরীক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং গবেষণার মানোন্নয়ন।

৫. পরিবহনব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ, ব্যাটারিচালিত শাটল সেবা প্রচলন ও যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ করা।

৬. হয়রানিমুক্ত প্রশাসনিক সেবা, শিক্ষা ঋণ ও ক্যাম্পাসভিত্তিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা।

৭. তরুণদের গঠনমূলক কাজে সম্পৃক্তকরণ এবং ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বৃদ্ধি।


৮. শিক্ষার্থীদের জন্য ডিজিটাল সুবিধা, সাইবার নিরাপত্তা ও সাইবার বুলিং প্রতিরোধ।

৯. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ সংরক্ষণ, সবুজায়ন ও প্রাণিবান্ধব ক্যাম্পাস তৈরি।

১০. কার্যকর ডাকসু এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধিকরণ।


ছাত্রশিবিরের ৩৬ দফা ইশতেহার:

১. ডাকসু নির্বাচনকে অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডারে অন্তর্ভুক্ত করে প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন আয়োজন।

২. ফ্যাসিবাদমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা, গেস্টরুম ও গণরুম সংস্কৃতির অবসান এবং সব নিপীড়নের তদন্ত ও বিচার।

৩. প্রথম বর্ষ থেকেই হলে বৈধ আসন নিশ্চিত করা। আবাসন সমস্যা সমাধানে অস্থায়ী হোস্টেল নির্মাণ বা ভাতা দেওয়া এবং নতুন হল নির্মাণ।

৪. স্বাস্থ্যকর খাবার নিশ্চিতে পুষ্টিবিদের তত্ত্বাবধানে তালিকা প্রণয়ন, মান পরীক্ষার ব্যবস্থা ও ‘মিল ভাউচার’ চালু।

৫. নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থা করা। ছাত্রী হলে নারী কর্মচারী ও নারী প্রক্টর নিয়োগ।

৬ অনাবাসিক ছাত্রীদের হলে প্রবেশাধিকার দেওয়া এবং অভিভাবকদের জন্য ‘গার্ডিয়ান লাউঞ্জ’ তৈরি।

৭. মাতৃত্বকালীন ছুটি কার্যকর করা। এ সময় পরীক্ষায় অংশ নিতে উপস্থিতির বাধ্যবাধকতা শিথিল করা।

৮. কমন রুমে নারী কর্মচারী রাখা, ‘ব্রেস্টফিডিং রুম’ ও ‘চাইল্ড কেয়ার কর্নার’ স্থাপন।

৯. পেপারলেস রেজিস্ট্রার ভবন ও উচ্চশিক্ষা সহায়তায় ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ চালু।

১০. ডাকসু ওয়েবসাইট উন্নয়ন এবং অ্যাপ চালু করে তথ্যপ্রবাহ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ।

১১. শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি বাস্তবায়ন, ‘মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম’, ই-লাইব্রেরি ও কম্পিউটার কেন্দ্র স্থাপন।

১২. ‘রিসার্চ ফেস্ট’, ‘ট্রাভেল গ্রান্ট’ চালু ও নিয়মিত সেমিনার আয়োজন।

১৩. কেন্দ্রীয়, হল ও বিভাগীয় পাঠাগারকে সম্প্রসারণ এবং আধুনিকীকরণ করা।

১৪. শিক্ষার্থীদের ‘সফট স্কিল’ বাড়াতে কর্মশালা, চাকরি মেলা ও স্টার্টআপ সম্মেলন আয়োজন।

১৫. অ্যালামনাই নেটওয়ার্ক শক্তিশালীকরণ এবং উন্নয়নে তাদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিতকরণ।

১৬. উপাসনালয়ের উন্নয়ন এবং ছাত্রীদের জন্য উপযুক্ত ইবাদতের পরিবেশ নিশ্চিত করা।

১৭. মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ ও কাউন্সিলিং সুবিধা বৃদ্ধি।

১৮. মেডিকেল সেন্টার আধুনিকীকরণ; ‘ডিইউএমসি’ অ্যাপ, বিশেষজ্ঞ নিয়োগ ও নারী চিকিৎসক নিশ্চিতকরণ।

১৯. হাসপাতালে বিশেষ ছাড় ও স্বাস্থ্যবিমা সমন্বয় এবং হলভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা ও ফার্মেসি স্থাপন।

২০. শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি চালু।

২১. ভাষা ইনস্টিটিউট আধুনিকীকরণ, বিদেশি শিক্ষক নিয়োগ ও রিসার্চ সেন্টার স্থাপন।

২২. গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো, আধুনিক যন্ত্রপাতি, সফটওয়্যার ও বিশেষ করে আইএলইটির ল্যাব উন্নয়ন।

২৩. বহিরাগত নিয়ন্ত্রণ ও রিকশা ব্যবস্থাপন, হকার উচ্ছেদ, নিবন্ধিত রিকশা ও ভাড়া তালিকা প্রণয়ন।

২৪. যৌন হয়রানি ও সাইবার বুলিং প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন ও আইনি সহায়তা।

২৫. ছাত্রীদের ঋতুচক্রের সময় পরিচ্ছন্নতা সামগ্রী বিনা মূল্যে একাডেমিক ভবনে সহজলভ্য করা।

২৬. ‘গ্রিভেন্স রেসপন্স টিম’ ও ‘ভিক্টিম সাপোর্ট সেল’ গঠন এবং ন্যায়পাল নিয়োগ।

২৭. ই-মেইলে প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি, জার্নাল ও অ্যাপ ব্যবহারে সহজলভ্যতা এবং অ্যালামনাইদের জন্য অফিসিয়াল ই-মেইলের ব্যবস্থা রাখা।

২৮. নতুন বাস কেনা ও ট্র্যাকিং অ্যাপ চালু এবং রুট, ট্রিপ ও অভ্যন্তরীণ শাটল সেবা চালু।

২৯. আইনি সহায়তা ডেস্ক গঠন করে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আইনি সহায়তা নিশ্চিতকরণ।

৩০. শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রের উন্নয়ন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও ইনডোর গেমস সম্প্রসারণ।

৩১. টিএসসি উন্নয়ন, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও সাউন্ডবক্স ব্যবহারে নীতিমালা প্রণয়ন।

৩২. প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপযোগী শ্রেণিকক্ষ ও শৌচাগার নিশ্চিত করা।

৩৩. নারী শিক্ষার্থীদের আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ চালু করা।

৩৪. হল কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু।

৩৫. শব্দ দূষণ, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও মাসিক পরিচ্ছন্নতা অভিযান।

৩৬. সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্যবাদ মোকাবিলা করে নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো।

শিক্ষার্থীদের ভাবনা:

শিক্ষার্থীরা বলছেন, ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির শিক্ষার্থীদের জন্য ইশতেহার দিলেও সেখানে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব রয়েছে। শিবিরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় যে অভিযোগগুলো সামনে এসেছে, তা নিয়ে ইশতেহার সাজিয়েছে ছাত্রদল। অন্যদিকে, এখানে গেস্টরুম সংস্কৃতি ছাত্রদলের হাত ধরে শুরু বলে বারবার অভিযোগ করে আসা শিবির তাদের ইশতেহারে বিষয়টি এনেছে। অর্থাৎ পরস্পরে কাদা ছোড়াছুড়ি লক্ষণীয়। তবে যে পক্ষই জিতুক, ইশতেহার বাস্তবায়ন হলে ক্যাম্পাসের চিত্র বদলে যাবে বলে মনে করেন তারা।

প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাজিদ হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি তিনটি প্যানেলের ইশতেহার পড়েছি- ছাত্রদল, ছাত্রশিবির ও উমামা ফাতেমার প্যানেলের। এর মধ্যে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে ছাত্রদল শিবিরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো তোলে, সেটা তাদের ইশতেহারে এসেছে। আবার শিবির ছাত্রদলের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনে বক্তব্য-বিবৃতি দেয়, তাদের ইশতেহারে তারা সেগুলো সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এটা ইন্টারেস্টিং। আমি মনে করি, দুই পক্ষের যেই জিতুক, তারা ইশতেহার বাস্তবায়ন করুক। যারা হেরে যাবে, তারাও তাদের ইশতেহার বাস্তবায়নে চেষ্টা করুক। তাহলেই সুন্দর ক্যাম্পাস পাবো আমরা।’

এ নিয়ে কথা হলে ঢাবি শিবিরের সেক্রেটারি ও ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) প্রার্থী মহিউদ্দিন খান দাবি করেন, কাদা ছোড়াছুড়ি নয়, শিক্ষার্থীদের দাবি বিচেনায় রেখে ইশতেহার সাজানো হয়েছে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের যে সমস্যাগুলো আমাদের সামনে এসেছে, আমি খুঁজে বের করতে পেরেছি, তার সবগুলোই আমরা ইশতেহারে যুক্ত করেছি। শিক্ষার্থীদের সমস্যা ও সংকটই আমাদের প্রতিশ্রুতিতে জায়গা পেয়েছে। অন্য কিছু নেই।’

একই রকম দাবি ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের এজিএস প্রার্থী তানভীর আল হাদী মায়েদেরও। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাবির শিক্ষার্থীরা নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত। আমরা তাদের সমস্যা নিরসন ও সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলতে কাজ করতে চাই। সেই প্রতিশ্রুতিই আমাদের ইশতেহারে তুলে ধরেছি।’

এই বিভাগের আরো খবর