ব্রেকিং:
জাকসু নির্বাচনের ফলাফল পেতে ১২ সেপ্টেম্বর দুপুর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের সদস্য সচিব অধ্যাপক রশিদুল আলম।

শুক্রবার   ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫   ভাদ্র ২৭ ১৪৩২   ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
৩৩

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি: বিশ্ব রাজনীতির নতুন বাস্তবতা

রাফিউল তালুকদার

প্রকাশিত: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫  

গাজায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ৬২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এই গণহত্যা শুধু মানবিক সংকটই বাড়ায়নি, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতির দাবিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।

ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া কোনো নতুন বিষয় নয়। ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিক থেকে এ স্বীকৃতি বাড়তে শুরু করে। তবে গত এক দশক ধরে পশ্চিমা দেশগুলোও ধীরে ধীরে এই ধারায় যোগ দিচ্ছে।

২০২৪ সালের মে মাসে আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে ও স্পেন যৌথভাবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর একে একে আরও কয়েকটি দেশ এ পথে হাঁটে। সর্বশেষ ২০২৫ সালের জুলাইয়ে ফ্রান্স ঘোষণা করেছে, সেপ্টেম্বরে শুরু হতে যাওয়া জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবে তারা। এটি বাস্তবায়িত হলে এবারই প্রথম কোনো জি-৭ রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিবে।

ফ্রান্সের পর ২৯ জুলাই যুক্তরাজ্য, ৩০ জুলাই কানাডা এবং ১১ আগস্ট অস্ট্রেলিয়া একই পথে হাঁটার ঘোষণা দেয়। যদিও এসব ঘোষণায় নানা শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে, তবু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এটি এক বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত।

রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতির শর্ত 

আন্তর্জাতিক আইনে রাষ্ট্রের সংজ্ঞা নিয়ে মতভেদ আছে। ১৯৩৩ সালের মন্টেভিডিও কনভেনশনের শর্ত অনুযায়ী রাষ্ট্র হতে হলে স্থায়ী জনসংখ্যা, সুনির্দিষ্ট ভূখণ্ড, স্বাধীন সরকার, অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের সক্ষমতা এই চারটি মানদণ্ড পূরণ করতে হয়। ফিলিস্তিন দীর্ঘদিন ধরেই এ শর্তগুলো অনেকাংশে পূরণ করেছে। যদিও পূর্ণাঙ্গ জাতিসংঘ সদস্যপদ এখনো অধরা।

জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য হতে হলে আবেদন জমা, নিরাপত্তা পরিষদে অনুমোদন (১৫ সদস্যের মধ্যে ৯ ভোট ও সব স্থায়ী সদস্যের সম্মতি), সাধারণ পরিষদে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট এই তিন ধাপ অতিক্রম করতে হয়। ফিলিস্তিন ইতোমধ্যেই সাধারণ পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন পেয়েছে। কিন্তু প্রধান বাধা হলো নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো। রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য এখন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখলেও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এখনো অপরিবর্তিত।

ঐতিহাসিক পথচলা

১৯৪৮ – নাকবা: জাতিসংঘের বিভাজন প্রস্তাবের পর ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠিত হয়। একই সঙ্গে প্রায় ৭.৫ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়।
 

১৯৭৪ – পিএলও স্বীকৃতি: জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থাকে (পিএলও) ফিলিস্তিনি জনগণের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে ঘোষণা করে।
 

১৯৮৮ – স্বাধীনতার ঘোষণা: আলজিয়ার্সে নির্বাসিত সরকার থেকে ইয়াসির আরাফাত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আরব ও উন্নয়নশীল দেশগুলো তার এই ঘোষণাকে ব্যাপকভাবে সমর্থন দেয়।
 

১৯৯৩ – অসলো চুক্তি: সীমিত স্বশাসনের অধীনে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) গঠিত হয়। তবে সমালোচকদের মতে, এটি রাষ্ট্র গঠনের পরিবর্তে বিভাজনকে স্থায়ী করে।
 

২০১২ – জাতিসংঘে নতুন মর্যাদা: ফিলিস্তিনকে পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়া হয়, যদিও পূর্ণ সদস্যপদ মিলেনি।
 

গাজায় চলমান যুদ্ধ ও নতুন চাপ

গাজায় ভয়াবহ গণহত্যা এবং দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতির দাবিতে বৈশ্বিক চাপ বেড়েছে। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দিয়ে ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ আটকে দেয়। তবে একই বছর সাধারণ পরিষদে বিপুল ভোটে ফিলিস্তিনকে আরও কিছু অতিরিক্ত অধিকার দেওয়া হয়।

২০২৫ সালের জুলাইয়ে জাতিসংঘে ফ্রান্স ও সৌদি আরবের সহ-আয়োজনে এক সম্মেলনে পশ্চিমা দেশগুলোর বড় অংশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে সমর্থনের ঘোষণা দেয়। যদিও ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র সেই সম্মেলন বয়কট করে।

বর্তমানে জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৪৭টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা মোট সদস্যের ৭৫ শতাংশের বেশি। সেপ্টেম্বরে ফ্রান্স ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিলে এ হার আরও বাড়বে।

৯ সেপ্টেম্বর শুরু হবে এবারের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ। ২৫ সেপ্টেম্বর ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি বক্তব্য দেবেন। তবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পূর্ণ স্বীকৃতি নির্ভর করছে নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের ওপর। যুক্তরাষ্ট্র যদি ভেটো দেয়, তাহলে এবারও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যাবে।

ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতির লড়াই আন্তর্জাতিক কূটনীতির ইতিহাসে এক দীর্ঘ ও জটিল অধ্যায়। বিশ্বের তিন-চতুর্থাংশ দেশ ইতোমধ্যেই স্বীকৃতি দিলেও যুক্তরাষ্ট্রের একক ভেটো এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তবে গাজায় চলমান ট্র্যাজেডি এবং বৈশ্বিক ক্ষোভ আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে নতুন মোড়ে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে।

এই বিভাগের আরো খবর