বুধবার   ৩০ জুলাই ২০২৫   শ্রাবণ ১৫ ১৪৩২   ০৪ সফর ১৪৪৭

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
১৯৯

চট্টগ্রামে আওয়ামীলীগের অভয়ারণ্য: সিন্ডিকেটের কবলে রাষ্ট্রীয় সম্পদ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৩ জুলাই ২০২৫  

ছৈয়দ সহীদ হাসান তার মূল পদবী – উচ্চহিসাব সহকারী, অর্থ ও হিসাব বিভাগ,চটগ্রাম বন্দর কতৃপক্ষ। বাড়ি-মাদারীপুর তবে তিনি একজন ১৬তম গ্রেডের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী হয়েও ১১তম লিয়াজু অফিসার পদ ভাগিয়ে নিয়ে ১৪ বছর ধরে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।

 

তিনি ১২/০৩/১৯৯৬ তারিখে জুনিয়র একাউন্টস এসিস্ট্যান্ট/জুনিয়র অডিটর পদে যোগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি পদোন্নতি পেয়ে ১৩তম গ্রেডের উচ্চ হিসাব সহকারী হন। ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে কপাল খুলে যায় তার। তার ভাশুর মাদারীপুরের এমপি শাহজাহান খান নৌ-পরিবহণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পাবার পরে চট্টগ্রাম বন্দরের ১১তম গ্রেডের লিয়াজু অফিসার পদের দায়িত্ব ভাগিয়ে নেন তিনি।

 

নিয়ম অনুযায়ী ১৩তম গ্রেডের কোন ব্যক্তি ১১তম গ্রেডের অতিরিক্ত বা চলতি দায়িত্ব পেতে পারেন না। কিন্তু সহীদ হাসান যেন চট্টগ্রাম বন্দরের অঘোষিত সম্রাট। তিনি ধীরে ধীরে চট্টগ্রাম বন্দরের মন্ত্রণালয় বিষয়ক সকল কাজ, নিয়োগ, পদোন্নতি, টিকাদারী পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন।

 

শাহজাহান খানের ভাশুর হিসেবে তাকে সবাই মন্ত্রীর এজেন্ট হিসেবে মানতে শুরু করে। শাহাজাহান খানের আমলের সকল নিয়োগ বাণিজ্য তার হাতে সম্পন্ন হতো। মন্ত্রণালয়ের আমলারা তাকে পদলেহন করে চলতো। ২০১১ সালে লিয়াজু অফিসার/সহকারী জনসংযোগ কর্মকর্তা/প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে ২জন কর্মকর্তা নিয়োগ পেলেও লিয়াজু অফিসার পদে ঢাকায় কাউকে কাজ করতে দেয়নি সহিদ হাসান। মন্ত্রীর নির্দেশে তিনিই বহাল থাকেন বছরের পর বছর।


এরপরে এই পদগুলোর ২টি পদ শুন্য হলেও ২০২২ সাল পর্যন্ত বারবার নিয়োগে আটকে দিয়ে টিকে যান সহীদ হাসান।শেষমেশ ২০২২ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষ লিয়াজু অফিসার/সহকারী জনসংযোগ কর্মকর্তা/প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে ৩ জন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়। এই পরীক্ষায় বিভাগীয় প্রার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকায় সহিদ হাসান অংশ নিয়ে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মাত্র -৬.৫ নম্বর পেয়ে অকৃতকার্য হন। এটা জানতে পেরে নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়ে আমলা,শাহজাহান খান ও বন্দর সচিব ওমর ফারুকের মাধ্যমে বন্দর কর্তৃপক্ষকে নানামুখী চাপ দিয়ে তাকে নিয়োগের জন্য চাপ দেন। কিন্তু বন্দরের লিখিত পরীক্ষার QR কোড সমৃদ্ধ টপশীটের মাধ্যমে লিখিত পরীক্ষা গ্রহণ করে ডিজিটাল রেজাল্ট প্রকাশিত হওয়ায় তিনি সেই চেষ্টায় ব্যর্থ হন।



পরবর্তীতে সাজ্জাত হোসেন নামে নবনিযুক্ত কর্মকর্তাকে লিয়াজু অফিসার পদে ঢাকায় নিযুক্ত করা হলেও সহীদ হাসানকেও লিয়াজু অফিসার পদে বহাল রাখা হয়। সাজ্জাত মূল পদের বিপরীতে নিয়োগ পেলেও সহিদ হাসানই লিয়াজু অফিসারের সকল কার্যক্রম চালাতেন।বন্দরের লিয়াজু অফিসারের একটিমাত্র পদ থাকলেও একইপদে পদায়ন হয় ২ জনের।
এটি বন্দরের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। একই পদে ২ জন পদায়ন করার মূল হোতা বন্দর সচিব ওমর ফারুক। তার নিয়োগ বাণিজ্য,টেন্ডার বাণিজ্য,পদোন্নতি বাণিজ্য সবকিছুর এজেন্ট হিসেবে সহিদ হাসান কাজ করে। সচিব ওমর ফারুক ও সহিদের এসব অপকর্মে সহযোগিতা না করায় লিয়াজু অফিসার সাজ্জাত-কে নভেম্বর,২০২৪-এ চট্টগ্রামে ফেরত আনা হয়। বন্দর সচিবের একান্ত অনুগত ব্যক্তি হিসেবে সহিদ হাসান সর্বজন স্বীকৃত।


ওমর ফারুক ও নৌপম চবক শাখার উপসচিব নজরুল ইসলাম আজাদের সহযোগিতায় ১৬ জানুয়ারি,২০২৫ তিনি নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের প্রটোকল অফিসারের দায়িত্ব ভাগিয়ে নেন!! যেটা নিয়ম অনুযায়ী একজন ৩য় শ্রেণীর কর্মচারী কখনওই পান না। ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম বন্দর রেস্ট হাউজে তার সিন্ডিকেট অত্যন্ত শক্তিশালী। তিনি রেস্ট হাউজে থেকে লিয়াজু অফিসারের কাজ করার কথা থাকলেও ইমরান-রাব্বিকে দিয়ে তিনি রেস্ট হাউজ নিয়ন্ত্রণ করেন।

 


তিনি থাকেন ঢাকায় রাজকীয় ফ্ল্যাটে। গড়েছেন বিপুল সম্পদ ও অর্থের পাহাড়। ব্যবহার করেন চট্টগ্রাম বন্দরের একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি। তার দৌড়াত্বে অতিষ্ঠ চট্টগ্রাম বন্দরের বেশিরিভাগ কর্মকর্তা। বন্দরের কর্মকর্তারা ঢাকায় গেলে অফিসিয়াল কাজে গাড়ির সংস্থান থাকলেও তারা বেশিরভাগ সময় তারা গাড়ির সুবিধা পান না।

 

 

সহিদ হাসান মন্ত্রণালয়ের আমলাদের কথা বলে পরিবারের কাজে ঢাকায় ও মাদারিপুরে ব্যবহার করেন একাধিক গাড়ি।প্রতি মাসে অস্বাভাবিক হারে জ্বালানি তেলের হিসাব দিয়ে হাতিয়ে নেন লক্ষ লক্ষ টাকা। শুধু তাই নয় মন্ত্রণালয়ে সভার কথা বলে প্রতি মাসে ৩-৪ লক্ষ টাকার বিল করেন তিনি। এসব বিল চবক বোর্ড সভায় পাশ করার দায়িত্ব নেন বন্দর সচিব ওমর ফারুক। বিনিময়ে এসব বিলের বিরাট একটা অংশ তিনি বন্দর সচিব ওমর ফারুককে দেন।

 


আর তাদের এসব কাজে বাধা দেয়ায় লিয়াজু অফিসার সাজ্জাতকে কয়েকবার সতর্ক করেন বন্দর সচিব ওমর ফারুক। সহিদ হাসান ঢাকায় বন্দর চেয়ারম্যান, সসদস্যবৃন্দ, ওমর ফারুক ও কয়েকজন বিভাগীয় প্রধান ছাড়া অন্য কোন কর্মকর্তা অফিসিয়াল কাজে গেলে তাদের তোয়াক্কায় করেন না। কারণ মূল শক্তি বন্দর সচিব ওমর ফারুক। তারা দুজন মন্ত্রণালয়ে সকল অপকর্মের পার্টনার। ওমর ফারুক আওয়ামী আমলের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী।

 


সাবেক সিবিএ সাধারণ সম্পাদক নায়েবুল ইসলাম(ফটিক)- এর ঘনিষ্টজন হিসেবে ওমর ফারুক কোটি কোটি টাকার নিয়োগ, পদোন্নতি বাণিজ্য করে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন।বোর্ড সভায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিল/কাজ পাস করিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। তার ২ ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে সেটেল করে অস্ট্রেলিয়া পড়ালেখার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন। ছেলেদের বউসহ তিনি অস্ট্রেলিয়ায় সেটেল করেছেন। চট্টগ্রাম বন্দরে তার পদের প্রভাব খাটিয়ে তারই ভাগ্নে আরাফাতকে দিয়ে বিভিন্ন বিভাগে করেন ঠিকাদারি ব্যবসা।

 


তার ব্যবহৃত বন্দরের আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত ৪৫ লক্ষ টাকা মুল্যের Toyota, premio চট্টমেট্রো-গ -১৪-২৮৮১ গাড়িটি তার নিজের বলে জানা গেছে। তার শ্যালক আলভির চট্টগ্রামস্থ প্রতিষ্ঠান P2P ও Wecon এ রয়েছে তার বিপুল টাকার গোপন বিনিয়োগ।এছাড়াও তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রামে নামে-বেনামে কিনেছেন বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও জমি। অনন্যা  এলাকায় আছে তার একাধিক প্লট।

 


তার এসব দুর্নীতির কারণে তিনি পরিচালক(প্রশাসন) পদে পদোন্নতি পান নি। অথচ তিনি এখন নিজেকে বিএনপি জামাতের লোক বলে পরিচয় দেন। আবার সহিদ হাসানকে ঢাকায় মন্ত্রণালয়ে রাখার জন্য সর্বদা সজাগ থাকেন। জানা গেছে, শাহজাহান খান বর্তমানে জেলে থাকলেও তাকে জেলে অর্থ সরবরাহ করেন সহিদ হাসান। আর শাহজাহান খানের পরামর্শে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম চালান সহিদ হাসান।

 


অপরদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তা শেখ নাসেরের নিকট আত্মীয় সদস্য (প্রকৌশল) কমডোর কাওসার রশিদ। ততকালীন দুনীতিবাজ ও ৭ মাডার এর অন্যতম আসামী রিয়ার এডমিরাল সোহায়ের তার সহযোগি হিসেবে তাড়াহুড়া করে ফ্যাসিস সরকারের আমলে দুনীতিবাজ সদস্য (প্রেকৌশল) কমডোর কাওসার রশিদ কে চট্টগ্রাম বন্দরে পদায়ন করেন। শেখ পরিবারের আত্মীয়তার খাতিরে সোয়েল তার হাতকে আরো শক্তিশালী করার জন্য দুনীতিবাজ কে বন্দরে আনয়ন করেন। তার দুনীতির ২/৩ টি উদাহর দেয়া ই যেতে পারে; তার নিয়ন্রেি  গুরুত্বপূণ কয়েটি বিভাগ যে, যান্ত্রিক বিভাগ, ভান্ডার বিভাগ, প্রকৌশল বিভাগ, বিদ্যু বিভাগ। যান্ত্রিক বিভাগের কিছু দুনীতি যেমন, নথি নং- ১৮.১৩.০০০০.৩৮৩.০৭.১৫৪.২৪ চুক্তি সি/০৪৪/২০২৪-২৫, তারিখ ২৭/০৩/২০২৫, কান্ট্রি  অব অরজিন বেলজিয়াম ও চায়না। নথি নং-১৮.১৩.০০০০.৩৮৩.০৭.২৪৪.২৪, চুক্তি নং সি ০৩৯/২০২৪-২৫ তারিখ ১৭/০৩/২৪ কান্ট্রি  অব অরজিন দুবাই। নথি নং- ১৮.১৩.০০০০.৪২৩.০৭.০৩৬.২৪, জোন-ডি, চুক্তিনামার তারিখ ২৪/০২/২০২৫ কান্ট্রি  অব অরজিন কুরিয়া। নথি নং- ১৮.১৩.০০০০.৩৮২.০৭.০৪১.২৩, চুক্তিনামা নং সি ০১৫/২০২৪-২৫, তারিখ ১১/০৩/২০২৫ কান্ট্রি  অব অরজিন বেলজিয়াম, কাজ দূনীতিবাজ সদস্য প্রকৌশল দিয়েছে আওমীলীগের ফ্যাসিস আমলের শিক্ষামন্ত্রী নওফের এর ছো্ট বোন জামাইকে। এখানে উল্লেখ্য যে, এসব মালামাল/ যন্ত্রাংশ স্বপক্ষে ঠিকাদার যে সব ডকুমেন্ট দিয়েছেন তার সব কটিই ভূয়া ও বানোয়ার, যা কাস্টম/এয়ায়পোট কাস্টম এ ইনবোয়চ ও কাস্টম এর সকল ডকুমেন্ট জাল ও বানোয়াট। যা তদন্ত করলেই দুর্নীতির প্রমান মিলবে । এ সব দুর্নীতির মুলহুতা হচ্ছেন সদস্য প্রকৌশল কাওসার রশিদ। প্রতি ঠিকাদার থেকে মূল টাকার ২৫% হারে সদস্য প্রকৌশল নিয়ে ভূয়া বানোয়ার ডকুমেন্ট সত্য বলে বিল প্রদানের সুপারিশ করে থাকেন।  সচিব ওমর ফারুক,(এনামুল করিম পরিচালক (পরিবহণ) কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন, তার ছোট ভাই বোন সকলেই আমেরিকায় সেটেল। সাইফ পাওয়ার থেকে প্রতি মাসে মোটা অংকের মাসোহারা নিচ্ছেন তিনি । তিনি বিয়ে করেছেন দুইটি। , ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় তার ৪টি ফ্লাট রয়েছে। চট্টগ্রামের মনির নগর মুন্সিপাড়া এলাকায় তার দশ কাঠা জমির উপর বিলাসবহুল বাড়ি।

 

বর্তমানে এই এনামুল করিমের বিরুদ্ধে চারটি দুর্নীতির মামলা চলমান ২টি ঢাকায়,  ২ টি চট্টগ্রামে।), পলাতক সাবেক সিবিএ সাধারণ সম্পাদক (ফটিক) ও তার অনুসারী টিকাদারপগণ এবং উপ-সচিব পরিচালক (প্রশাসন) চট্টগ্রাম বন্দর মোঃ মমিনুর রশিদ সিন্ডিকেট করে পুরো চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ন্ত্রণ করছেন এখনও। তাদের কথার বাইরে কিছুই ঘটেনা চট্টগ্রাম বন্দরে।

 


আর ফটিকের সাথে নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ করে সমন্বয় করেন পরিচালক (প্রশাসন) মমিনুর রশিদ, সচিব ওমর ফারুক ও পরিচালক(পরিবহন) এনামুল করিম। সাইফ পাওয়ার টেকসহ বড় বড় টিকাদাররাও তাদের হাতের মুঠোয়। পুরো বাংলাদেশে ফ্যাসিস্টদের আধিপত্য কমলেও চট্টগ্রাম বন্দর জিম্মি করে অবলিলায় ব্যবসা করে যাচ্ছে ফ্যাসিস্টদের দোসররা।


যেন দেখার কেউ নেই। বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরের এই অবস্থা হলে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে যেকোন সময় ফ্যাসিস্ট বাহিনী বড় ধরণের অঘটন ঘটে যেতে পারে। তাই অতি সত্ত্বর চট্টগ্রাম বন্দরকে ফ্যাসিস্ট মুক্ত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। না হয় সেটা জুলাই আন্দোলনের শহীদদের রক্তের সাথে বেইমানি করা হবে।

এই বিভাগের আরো খবর