ব্রেকিং:
বিপিএল কবে, জানাল বিসিবি ফোনালাপ ফাঁসের জেরে থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বরখাস্ত

মঙ্গলবার   ০১ জুলাই ২০২৫   আষাঢ় ১৭ ১৪৩২   ০৫ মুহররম ১৪৪৭

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
১৯

বগুড়ায় হচ্ছে নগরায়ণের নতুন মানচিত্র

নিজস্ব প্রতিবেদক    

প্রকাশিত: ১ জুলাই ২০২৫  

 

  • সিটি করপোরেশন গঠনে নতুন এলাকা অন্তর্ভুক্তির চিন্তা
  • শিগগিরই যাচ্ছে গেজেট প্রকাশের সুপারিশ
  • তৈরি হবে নতুন শিল্প ও বাণিজ্যিক সুযোগ

উত্তরাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক শহর বগুড়া এবার পৌরসভার সীমা ছাড়িয়ে পূর্ণাঙ্গ সিটি করপোরেশনের পথে এগোচ্ছে। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে গেজেট প্রকাশের জন্য প্রস্তাবনা পাঠানো হবে বলে নিশ্চিত করেছে জেলা প্রশাসন।


স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক ও বগুড়া পৌরসভার প্রশাসক মাসুম আলী বেগ বলেন, গণশুনানিতে আসা মতামত ও প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে দ্রুত আমরা সুপারিশ পাঠাচ্ছি। সিটি করপোরেশন গঠনের জন্য মানদণ্ড অনুযায়ী বগুড়া পৌরসভা প্রস্তুত।

বগুড়া শুধু উত্তরাঞ্চলের নয়, দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবেও দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত। এর ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, কৃষি শিল্পের যোগসূত্র, ব্যবসা-বিনিয়োগের প্রসার ও প্রশাসনিক সুবিধা মিলে শহরটিকে ‘সিটি করপোরেশন’ মর্যাদার দাবি রাখার উপযোগী করে তুলেছে।


বগুড়া পৌরসভা এলাকার আনুমানিক জনসংখ্যা ৫.২৫ লাখ (২০২৩ সালের জাতীয় ভোটার তালিকা অনুসারে ভোটার সংখ্যা প্রায় ৩.৬০ লাখ)। সিটি করপোরেশন ঘোষণার জন্য স্থানীয় সরকার বিধিমালা অনুযায়ী ন্যূনতম জনসংখ্যা হতে হয় ৫ লাখ যা বগুড়া পৌরসভা এককভাবেই পূরণ করে ফেলেছে।

প্রস্তাবনা অনুসারে পৌরসভার সীমানা ছাড়িয়ে শহরতলির যেসব ইউনিয়ন বর্ধিত মহানগরীর অংশ হতে পারে যেমন সাবগ্রাম, রাজাপুর, নিশিন্দারা, এরুলিয়া, ফাঁপোড় ও আশেকপুর। সেগুলোর জনসংখ্যা যুক্ত করলে সম্ভাব্য নগরের জনসংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৮.৫ থেকে ৯ লাখ। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ মহানগরীর জন্য আদর্শ জনঘনত্ব তৈরি করে। বগুড়া শহরে বিগত দুই দশকে জনসংখ্যা বেড়েছে গড়ে ২.৮% হারে, যা জাতীয় গড়ের (১.৩%) চেয়ে অনেক বেশি। দ্রুত নগরায়ণের ফলে স্কুল, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট, বাজার সবকিছুর ওপর চাপ বাড়ছে।

বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বগুড়া জেলার মাথাপিছু আয় ছিল প্রায় ২,৬০০ মার্কিন ডলার। এটি জাতীয় গড়ের (২,৫৫০ ডলার) চেয়েও কিছুটা বেশি। অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি সিটি করপোরেশনের মর্যাদার অন্যতম যোগ্যতা।

বগুড়া পৌরসভার নিজস্ব রাজস্ব আয় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল প্রায় ৩২ কোটি টাকা। যার মধ্যে পৌরকর প্রায় ৯.৮ কোটি, ট্রেড লাইসেন্স, বাজার ফি ও নির্মাণ অনুমতির রাজস্ব প্রায় ৬.৫ কোটি, হাট-বাজার ইজারা ও পরিবহন লাইসেন্স প্রায় ৭ কোটি টাকা। বাকি রাজস্ব আসে ভাড়া, বিজ্ঞাপন ও জলকর থেকে। এই পরিমাণ আয় অনেক জেলা শহরের পৌরসভার চেয়ে তিনগুণ বেশি এবং জাতীয় গড় রাজস্ব আয় তুলনায় বহুগুণে এগিয়ে।

জানা গেছে, বগুড়া পৌরসভাকে সিটি করপোরেশনে রূপান্তরের প্রক্রিয়া চলতি বছরের এপ্রিলে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। এরপর নির্ধারিত বিধিমালার আলোকে একে একে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ধাপ অতিক্রম করেছে জেলা প্রশাসন। বর্তমানে প্রক্রিয়াটি পৌঁছেছে চূড়ান্ত সুপারিশপত্র পাঠানোর পর্যায়ে।


জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানোর প্রস্তুতি এরইমধ্যে শেষ হয়েছে। এখন শুধু স্বাক্ষর-সংবলিত চিঠি পাঠানোর অপেক্ষা। আগামী এক-দুই কর্মদিবসের মধ্যেই এটি পাঠানো হবে।

সিটি করপোরেশন ঘোষণার প্রাথমিক ধাপ হিসেবে জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজ ২৭ এপ্রিল গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেন। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) প্রতিষ্ঠা বিধিমালা, ২০১০ অনুযায়ী এতে বলা হয়, ৩০ দিনের মধ্যে কেউ আপত্তি বা মতামত দিতে চাইলে তা লিখিতভাবে জেলা প্রশাসকের কাছে দাখিল করতে হবে।

গণবিজ্ঞপ্তির পর নির্ধারিত সময়সীমা শেষে মে মাসজুড়ে অনুষ্ঠিত হয় গণশুনানি। এতে ২০ জনের বেশি ব্যক্তি, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান লিখিতভাবে মতামত ও সুপারিশ পেশ করেন। এসব মতামতের ভিত্তিতে অঞ্চল সম্প্রসারণ, নাগরিক সেবা কাঠামো এবং এলাকাভিত্তিক সংযুক্তি বিষয়ক সুপারিশ গ্রহণ করা হয়। গণশুনানির পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার শাখা সমস্ত আবেদন যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত সুপারিশপত্র তৈরি করেছে। এতে জনগণের মতামত, সিটি করপোরেশন ঘোষণার যোগ্যতা ও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংযুক্ত করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মাসুম আলী বেগ বলেন, সিটি করপোরেশন গঠনে যতগুলো প্রশাসনিক ধাপ প্রয়োজন, তার সবগুলো সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এখন দ্রুত মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হবে।

জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজ বলেন, বগুড়া পৌরসভা সকল শর্ত পূরণ করেছে। আমরা খুব দ্রুতই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে গেজেট প্রকাশের জন্য সুপারিশ পাঠিয়ে দেবো।

বগুড়া নগর উন্নয়ন ফোরামের সদস্যসচিব, অধ্যাপক আ.স. মালেক বলেন, আলোচনায় আমরা বলেছি শুধু পৌর এলাকা নয়, সাবগ্রাম, রাজাপুর, নিশিন্দারা, এরুলিয়া, ফাঁপোড় ও আশেকপুর ইউনিয়নকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কারণ শহরের বাস্তব সম্প্রসারণ এই এলাকাগুলোর মধ্যেই।


কুটুরবাড়ি পূর্বপাড়া এলাকার শহিদুল ইসলাম বলেন, পৌর কর দিই, কিন্তু সেবার অভাব প্রকট। সিটি হলে ন্যায্যভাবে নাগরিক সুবিধা চাই।

ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বগুড়া শহরে বাইরের এলাকা থেকেও প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আসছে। সঠিক পরিকল্পনা ছাড়া নাগরিক চাপ বাড়তেই থাকবে।
এদিকে বগুড়া সিটি করপোরেশন গঠনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে সীমানা নির্ধারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বগুড়া শহরের প্রাথমিক পৌর এলাকা ছাড়াও, শহরতলির পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চলগুলো অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে প্রস্তাবনা তৈরি হয়েছে। জেলা প্রশাসন এরইমধ্যে সীমানা সম্প্রসারণের প্রাথমিক পরিকল্পনা তৈরি করেছে, যা আগামী দিনে সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন কাঠামো ও নগরায়ণের গতি বাড়াতে সহায়ক হবে।


সাবগ্রাম, রাজাপুর, নিশিন্দারা, এরুলিয়া, ফাঁপোড়, আশেকপুর এই ৬টি ইউনিয়নকে সিটি করপোরেশনের আওতায় আনার প্রস্তাবনা রয়েছে। এই এলাকাগুলো দ্রুত নগরায়ণ হওয়ায় এবং শহরের সঙ্গে সংযোগ বাড়ানোর কারণে সিটি করপোরেশন অন্তর্ভুক্তির জন্য উপযুক্ত।

এসব ইউনিয়নে দ্রুত শহর বিস্তার ঘটছে, ফলে আঞ্চলিক উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই এলাকার অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন। বড়গোলা, উপশহর, মালতীনগর, নাটোর রোডসহ শহরের প্রবেশদ্বারে অবস্থিত বাজারগুলো ও খুচরা বাণিজ্য কেন্দ্রগুলি সিটি করপোরেশনের আওতায় আসলে নগরীজুড়ে সেবার মান বাড়াতে সহায়ক হবে। এখানে কয়েক হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শপিং মল ও পাইকারি বাজার রয়েছে, যা সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

অপরদিকে ফাঁপোড়-আশেকপুর এলাকা বগুড়ার অন্যতম শিল্পাঞ্চল। এখানে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, যেমন মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানি, ছোট-মাঝারি আঞ্চলিক শিল্প এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র। সিটি করপোরেশন অন্তর্ভুক্তির ফলে শিল্প এলাকার পরিবেশ উন্নয়ন এবং সুষ্ঠু নীতি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। এটি স্থানীয় শিল্পকারখানার জন্য আরও উন্নত অবকাঠামো এবং সেবা প্রদান করবে।

বলা হচ্ছে, নতুন সীমানা অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বগুড়া শহরের নির্দিষ্ট অঞ্চলগুলোর মধ্যে যুক্ত হওয়া, উন্নত নগরায়ণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং অবকাঠামো উন্নয়ন সম্ভব হবে। এতে শহরের বর্ধিত এলাকা মোটামুটি একই ধরনের পরিকল্পনা এবং সেবা পাবে। নতুন অঞ্চল অন্তর্ভুক্তির ফলে রাজস্ব আদায়ে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি আশা করা হচ্ছে। স্থানীয় কর, সেবা চার্জ ও অন্যান্য বিপণন করের মাধ্যমে সিটি করপোরেশন অতিরিক্ত আয় অর্জন করবে।

ফাঁপোড়-আশেকপুর শিল্পাঞ্চলকে সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে সেখানে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য উন্নত নীতিমালা, উন্নত অবকাঠামো এবং সহজতর সেবা নিশ্চিত করা হবে। এটি বিশেষ করে শিল্পোন্নয়ন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য সহায়ক হবে। এছাড়া শহরের সীমা বাড়ানো হলে, সংশ্লিষ্ট এলাকার নাগরিকদের জন্য উন্নত নাগরিক সেবা, যেমন পানি সরবরাহ, সড়ক উন্নয়ন, ডাস্টবিন পরিষ্কার, বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সেবাও নিশ্চিত করা যাবে।


বগুড়া চেম্বার অব কমার্সের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাইরুল ইসলাম বলেন, শহরের উন্নয়ন কেবল পৌরসভার সীমানা বাড়ানোতে সীমাবদ্ধ নয়, এটি আরও বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ। সিটি করপোরেশন হলে নতুন শিল্প ও বাণিজ্যিক সুযোগ তৈরি হবে, যা আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে।


সুশসানের জন্য প্রচারাভিযান সুপ্র’র জেলা সম্পাদক কেজিএম ফারুক বলেন, প্রশাসনের প্রস্তাবিত সীমানা সম্প্রসারণ পরিকল্পনা বগুড়া সিটি করপোরেশন গঠনের প্রক্রিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন শহরের গতি ও পরিচিতি বৃদ্ধি পাবে, তেমনি নাগরিকদের জন্য উন্নত সেবা প্রদান, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি এবং শহরকে একটি পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগও সৃষ্টি হবে। এতে করে বাজেট বাস্তবায়ন, পরিকল্পনা গ্রহণ ও কর ব্যবস্থাপনায় পৌরসভার তুলনায় অধিক ক্ষমতা থাকবে। সিটি করপোরেশন বাস্তবায়ন হলে নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ট্রাফিক কন্ট্রোল, মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী রোড, মার্কেট, আবাসন ও সবুজ এলাকা সংরক্ষণ এবং সরকারি ও বেসরকারি প্রকল্পে বিনিয়োগ সহজ হবে।

এই বিভাগের আরো খবর