বৃহস্পতিবার   ১০ অক্টোবর ২০২৪   আশ্বিন ২৫ ১৪৩১   ০৬ রবিউস সানি ১৪৪৬

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
১৪৯

পলিথিন নিষিদ্ধের প্রয়োজনীয়তা, বিকল্প, এবং সরকারের ভূমিকা

সীমান্ত আরিফ বিশেষ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪  

পলিথিন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও এর প্রভাব পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি এবং পরিবেশগত ঝুঁকি বেশি, সেখানে পলিথিনের ব্যবহারে সৃষ্ট সমস্যা আরও জটিল হয়ে উঠেছে। সরকার বারবার পলিথিন নিষিদ্ধের চেষ্টা করলেও এর ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এ প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব কেন পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করা জরুরি, এর বিকল্প উপায় এবং পলিথিন বন্ধে সরকারের ভূমিকা নিয়ে দৈনিক তরুন কন্ঠের সাথে খোলামেলা কথা বলেছেন, বেসিক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক  ইফতেখার হোসেন,। 

প্রশ্ন: পলিথিন ব্যবহার কেন বন্ধ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন?
ইফতেখার হোসেন : পলিথিনের ব্যবহার আমাদের পরিবেশের ওপর ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এটি মাটিতে মিশতে কয়েকশ বছর সময় নেয়, ফলে মাটি দূষিত হয় এবং তার উর্বরতা নষ্ট হয়। নালা ও ড্রেনেজ সিস্টেমে পলিথিন জমে গিয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে, যা শহরাঞ্চলে বন্যার ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়া, পলিথিন সমুদ্র ও নদীতে ফেলে দেওয়ার ফলে জলজ প্রাণীর জীবন হুমকির মুখে পড়ে। অনেক প্রাণী ভুলবশত পলিথিন খেয়ে ফেলে, যা তাদের মৃত্যুর কারণ হয়। স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে, কারণ এটি থেকে বের হওয়া ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান আমাদের খাবার এবং পানির সঙ্গে মিশে যায়।
প্রশ্ন: তাহলে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে কী কী ব্যবহার করা যেতে পারে?
বিশেষজ্ঞ: পলিথিনের বিকল্প হিসেবে বেশ কিছু পরিবেশবান্ধব উপকরণ রয়েছে। প্রথমত, পাটের ব্যাগ যা বাংলাদেশের মতো দেশে সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী। এটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য। এছাড়াও কাপড়ের ব্যাগ একটি টেকসই এবং বারবার ব্যবহারযোগ্য বিকল্প। পেপার ব্যাগও একটি কার্যকর বিকল্প হতে পারে, যেহেতু এটি পচনশীল এবং সহজলভ্য। আর বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক একটি সম্ভাবনাময় বিকল্প, যা পরিবেশে দ্রুত মিশে যায়। তবে এটি তুলনামূলক ব্যয়বহুল, তাই এর উৎপাদন ও ব্যবহার সহজলভ্য করতে হবে।

প্রশ্ন: পলিথিনের ব্যবহার বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কেন এটি নিষিদ্ধ করা এত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন?
ইফতেখার হোসেন : ধন্যবাদ, পলিথিন নিষিদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা আমি কয়েকটি দিক থেকে ব্যাখ্যা করতে চাই। 
প্রথমত, পলিথিন একটি অ-বায়োডিগ্রেডেবল উপাদান, অর্থাৎ এটি সহজে মাটিতে মিশে যায় না। একটি সাধারণ পলিথিন ব্যাগ সম্পূর্ণরূপে পচতে প্রায় ৫০ থেকে ১,০০ বছর সময় নেয়। ফলে এটি মাটির গুণাগুণ নষ্ট করে এবং দীর্ঘ সময় ধরে পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক হয়ে থাকে। মাটিতে পলিথিন জমা হলে তা পানি শোষণের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, যার ফলে মাটি উর্বরতা হারায়। এটা আমাদের কৃষি ব্যবস্থার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।


দ্বিতীয়ত, পলিথিন আমাদের শহরাঞ্চলে জলাবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ। পলিথিন নালা এবং ড্রেনেজ সিস্টেম বন্ধ করে দেয়, যার ফলে বৃষ্টির পানি বা বর্জ্যপানি সহজে নিষ্কাশিত হতে পারে না। ঢাকা এবং অন্যান্য বড় শহরে বর্ষার সময় জলাবদ্ধতার যে সমস্যা দেখা দেয়, তার পেছনে পলিথিনের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তৃতীয়ত, পলিথিন সরাসরি প্রাণিকুলের জন্য বিপজ্জনক। পলিথিন আমাদের নদী, সমুদ্র এবং অন্যান্য জলাশয়ে মিশে গিয়ে জলজ প্রাণীর মৃত্যু ঘটায়। প্রাণীরা পলিথিন খেয়ে ফেলে, যা তাদের পাচনতন্ত্রে জমা হয় এবং তাদের মৃত্যুর কারণ হয়।

মানুষের স্বাস্থ্যের দিক থেকেও পলিথিন মারাত্মক হুমকি। এটি বিভিন্ন রাসায়নিক দিয়ে তৈরি হয়, যা খাদ্য বা পানির সংস্পর্শে এলে ক্ষতিকর হতে পারে। বিশেষ করে গরম খাবারের সঙ্গে পলিথিনের স্পর্শ হলে, তা থেকে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ খাবারে মিশে যায়, যা ক্যান্সারসহ বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি রোগের কারণ হতে পারে। তাই পলিথিনের ব্যবহারে আমরা আমাদের পরিবেশ, অর্থনীতি এবং স্বাস্থ্যের ওপর যে ঝুঁকি তৈরি করছি, তা ব্যাপক।
প্রশ্ন: পলিথিন নিষিদ্ধের পেছনে এসব বৈজ্ঞানিক কারণ তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, পলিথিনের সহজলভ্যতা ও সস্তা মূল্য মানুষকে এটি ব্যবহারে উৎসাহিত করে। এর বিকল্প হিসেবে কি কিছু ব্যবহার করা যেতে পারে?
ইফতেখার হোসেন : খুব ভালো প্রশ্ন। পলিথিনের বিকল্প বের করা অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। পলিথিনের সস্তা মূল্যের জন্য এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু আমরা যদি পরিবেশবান্ধব এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য বিকল্পগুলোর দিকে মনোযোগ দিই, তাহলে এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।
প্রথমত, পাটের ব্যাগ পলিথিনের অন্যতম কার্যকর বিকল্প হতে পারে। পাট বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানিকারক পণ্য এবং এটি পরিবেশবান্ধব। পাটের ব্যাগ সহজে পচনশীল এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য। এটি টেকসই এবং বিভিন্ন আকার ও আঙ্গিকে তৈরি করা যায়। পাটের ব্যবহার আমাদের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, কারণ এটি দেশের অভ্যন্তরে তৈরি হয় এবং কৃষকদের আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে।

দ্বিতীয়ত, কাপড়ের ব্যাগ একটি টেকসই বিকল্প। এটি একাধিকবার ব্যবহার করা যায় এবং মজবুত হওয়ায় দীর্ঘস্থায়ী হয়। কাপড়ের ব্যাগের সুবিধা হলো, এটি ধুয়ে আবারও ব্যবহার করা যায়, ফলে এর দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহার আমাদের প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও কাগজের ব্যাগ ব্যবহারের কথা বলা যেতে পারে। যদিও এটি কিছুটা দুর্বল এবং একবার ব্যবহারের পর নষ্ট হয়ে যেতে পারে, তবে এটি সহজেই পচনশীল। কাগজের ব্যাগ পরিবেশের ওপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না এবং লিথিনের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ। অন্যদিকে, আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক বা কম্পোস্টেবল প্লাস্টিকও একটি সম্ভাবনাময় বিকল্প। এই প্লাস্টিকগুলি প্রাকৃতিক উপাদান যেমন কর্ন স্টার্চ বা আলুর স্টার্চ দিয়ে তৈরি, যা পরিবেশে সহজে মিশে যায় এবং ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না। তবে বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিকের প্রধান সমস্যা হলো এর উচ্চ মূল্য। এ কারণে এটি এখনো ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না, কিন্তু ভবিষ্যতে এর উৎপাদন ব্যয় কমানো গেলে এটি পলিথিনের অন্যতম কার্যকর বিকল্প হতে পারে।

প্রশ্ন: এই বিকল্পগুলো সত্যিই কার্যকর হতে পারে। কিন্তু পলিথিন নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে সরকারের কী ভূমিকা থাকা উচিত?
ইফতেখার হোসেন: পলিথিন নিষিদ্ধ করতে হলে সরকারের ভূমিকা অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। যদিও বাংলাদেশে পলিথিনের বিরুদ্ধে আইন রয়েছে, কিন্তু এর বাস্তবায়ন অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বল। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে পলিথিনের উৎপাদন, ব্যবহার এবং বিক্রয় বন্ধ করতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বাজার মনিটরিং বাড়াতে হবে এবং আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিকল্প পণ্যগুলোর উৎপাদন ও ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে হবে। সরকার বিকল্প পণ্য তৈরির উদ্যোক্তাদের জন্য কর ছাড়, সহজ ঋণ, এবং অন্যান্য প্রণোদনা দিতে পারে। এতে বিকল্প পণ্যগুলোর উৎপাদন খরচ কমে আসবে এবং এগুলো সাধারণ মানুষের জন্য সাশ্রয়ী হবে। তৃতীয়ত, জনসচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে সরকারকে গণমাধ্যম, স্কুল, কলেজ এবং সামাজিক প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে প্রচারণা চালাতে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিবেশ সংরক্ষণের ধারণা ছড়িয়ে দিতে পাঠ্যপুস্তকে এই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। পরিশেষে, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। পরিবেশ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় প্রশাসনকে একযোগে কাজ করতে হবে। আইন প্রণয়ন থেকে শুরু করে বিকল্পের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা, প্রতিটি ধাপে সরকারের প্রতিটি বিভাগের একসঙ্গে কাজ করা জরুরি। 

সীমান্ত আরিফ: ধন্যবাদ ইফতেখার হোসেন । আপনার মূল্যবান পরামর্শ আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। আশা করি, পলিথিনের ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশ রক্ষায় আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করতে পারব। 
ইফতেখার হোসেন: ধন্যবাদ আপনাকেও, সামিনা। পরিবেশ সংরক্ষণের দায়িত্ব আমাদের সবার।
 

এই বিভাগের আরো খবর