বৃহস্পতিবার   ০৮ মে ২০২৫   বৈশাখ ২৪ ১৪৩২   ১০ জ্বিলকদ ১৪৪৬

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
২২১

পাটখাতে খুলনায় চার ব্যাংকের ৪ হাজার কোটি টাকা আদায় অনিশ্চিত

প্রকাশিত: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

কেন ঋণখেলাপি ঘোষণা করা হবে না’ কারণ দর্শানোর এমন চূড়ান্ত নোটিশ দেওয়ার দুই বছর পার হয়ে গেলেও খুলনায় সোনালী ব্যাংকের পাট খাতের ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে তাদের নতুন করে ঋণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পাট খাতের ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে চার দফা নীতিমালা পরিবর্তন করা হয়েছে। সেই সুযোগের এক বছর শেষ হয়ে গেলে বাস্তবে অগ্রগতি প্রায় শূন্য।

ফলে খুলনায় রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংকের পাট রপ্তানি খাতে বিনিয়োগকৃত প্রায় চার হাজার কোটি টাকার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অথচ একই অভিযোগে অনেক পাট ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে এবং প্রতারণা নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন পর্যন্ত মামলা করেছে।

বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা যায়, ২০০৭-২০০৮ অর্থবছর পর্যন্ত খুলনা অঞ্চলে চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বিনিয়োগ ছিল মাত্র দেড় হাজার কোটি টাকা। ২০০৯-১০ অর্থবছরে পাটের চাহিদা বেশি ও দেশীয় বাজার মণপ্রতি তিন হাজার টাকায় উন্নীত হলে হাতেগোনা কয়েকজন পাট রপ্তানিকারক ছাড়া সব রপ্তানিকারকদের ঋণ দ্বিগুণ হয়ে যায়। একইভাবে পাট রপ্তানিতে উৎসাহ দিয়ে সরকারি প্রণোদনায় শতকরা ১০ ভাগ এফডিআরের বিপরীতে শতকরা ১০০ ভাগ ঋণ দেওয়া হয়। ফলে রাতারাতি অনেক পাট ব্যাপারী থেকে রপ্তানিকারক হয়ে যান।

বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সেখানে রপ্তানিকারক ছিল মাত্র ৮৯ জন। এক বছরের ব্যবধানে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৩২৪ জনে।

একজন প্রবীণ পাট ব্যবসায়ীর মতে, এ সময় হঠাৎ করে দৌলতপুর বাজারে নামিদামি গাড়ির সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়। আর এর বড় অংশই রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে ব্রিফকেস ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়েছে।

সোনালী ব্যাংকের পক্ষে তাঁদের আইনজীবী এসএম ওজিয়ার রহমান গত ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই ১৫ দিনের সময় দিয়ে একাধিক ব্যবসায়ীকে চূড়ান্ত নোটিশ বা লিগ্যাল নোটিশ দেন। ওই নোটিশে উল্লেখ করা হয় যে, ১৫ দিনের মধ্য টাকা পরিশোধের ব্যবস্থা নেওয়া না হলে পাওনা আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালতে মামলা করা হবে।

সোনালী ব্যাংক জিএম অফিসের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, সোনালী ব্যাংকের খুলনা জোনের ছয়টি শাখায় ১১৩ জন পাট রপ্তানিকারকের কাছে ২০১৭ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত মোট এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। যার প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি শ্রেণিকৃত বা ঋণখেলাপি। এসব ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের শুরুতে চূড়ান্ত নোটিশ দেওয়া হয়। এই ১৮০০ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে এক হাজার ১০০ কোটি টাকা ছিল প্লেজ ঋণ। যার বিপরীতে গুদামের পাট ছাড়া আর কোনো জামানত ছিল না। প্লেজ ঋণের গুদামের পাটকেই জামানত হিসাবে ধরা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে এসব গুদাম সরেজমিনে পরিদশর্ন করে খাতায় নথিভুক্ত অনুযায়ী কোনো পাটই পাওয়া যায়নি।

একইভাবে পাট রপ্তানির আগে যে স্বল্প সুদে ‘পিসিসি ‘ ঋণ দেওয়া হয় কোনো জামানত ছাড়া তার পরিমাণও ৩৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ভুয়া এলসি দেখিয়ে ঋণ এবং গুদামে পাট না থাকলেও খাতাপত্রে পাট দেখিয়ে ঋণ নেওয়া ফৌজদারি অপরাধ পর্যায়ে পড়ে।

সোনালী ব্যাংকের এইরকম প্লেজ ঋণ নিলেও গুদামে পাট না থাকায় দুর্নীতি দমন কমিশন আট থেকে দশজন গ্রাহকের নামে মামলা করেছে। এসব মামলায় ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও আসামি করা হয়েছে।

গত সপ্তাহে একজন জিএমসহ চার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার জামিন বাতিল করে জেলেও পাঠিয়েছে। অথচ রাজনৈতিক প্রভাবে একই অপরাধে অপরাধী রাজনৈতিক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। বরং তাঁদের আগের টাকা বল্ক করে নতুন করে আবার ঋণ দেওয়া হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের পাটখাতের এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংক এই খাতে বিনিয়োগ দুই হাজার কোটি টাকা, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের পাট খাতের বিনিয়োগ করা প্রায় চার হাজার কোটি টাকা রাজনৈতিক তদবিরে ১০ বছরের বল্ক করে আবার নতুন ঋণ দেওয়া হচ্ছে।

সোনালী ব্যাংকের  সদ্য এলপিআরে যাওয়া খুলনা জোনের জেনারেল ম্যানেজারের দায়িত্বে থাকা ডিজিএম শেখ শাহাজান আলী জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে সোনালী ব্যাংক ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার গোলাম নবী মল্লিক ও জেনারেল ম্যানেজার মো. আব্দুল গফুর স্বাক্ষরিত ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারিতে ঋণখেলাপিদের জন্য চূড়ান্ত নোটিশ বা লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার স্বার্থে খুলনা প্রবীণ একজন পাট রপ্তাণিকারক এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘ব্যাংকের জামানত ছাড় এভাবে কোটি কোটি টাকা বল্ক ঋণসুবিধা নজিরবিহীন। আবার এই বল্কঋণ দুই বছর কোনো সুদ বা কিস্তি পরিশোধ ছাড়াই ১০ বছরের মেয়াদ দেওয়া হয়েছে। একইভাবে পাট রপ্তানির বিল থেকে শতকরা পাঁচ ভাগ কর্তন করে বল্ক ঋণ পরিশোধের যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তাতে এই চার হাজার কোটি টাকা পরিশোধ হতে ২০০ বছর লেগে যাবে। আবার যাদের গুদামে কোনো পাটই নাই সে ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। প্লেজ গুদামের পাট না থাকায় ইতিপূর্বে দুদক খুলনার একাধিক পাট রপ্তানিকারকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। ফলে কিছু ব্যবসায়ীর জন্য এক আইন আর অন্যদের জন্য ঋণ বল্ক করে নতুন ঋণ দেওয়া সংবিধান পরিপন্থি। একই অপরাধে এক দেশে দুই ধরনের বিচার থাকতে পারে না।’ তিনি বিষয়টিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অর্থ লুটপাট বলে আখ্যা দেন।

ওই পাট রপ্তানিকারক আরো বলেন, ‘ব্রিটিশ আমল থেকে প্রতিষ্ঠিত দৌলতপুরে পাট মোকামটি রাজনৈতিক ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যাংকের অর্থ লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে।’

এই বিভাগের আরো খবর