মঙ্গলবার   ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫   পৌষ ১ ১৪৩২   ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৭

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
৩৩

‘৫৪ বছর ধরে ভাত খাই না’

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫  

মুক্তিযুদ্ধ, যা আমাদের কাছে গৌরবের ইতিহাস, কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধার জন্য তা আজও বয়ে বেড়ানো এক গভীর ক্ষত। তেমনই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরজিৎ দাশ (৭১)। তিনি চট্টগ্রাম নগরে 'শুনু মামা' নামে পরিচিত। ৫৪ বছর আগে ঘটে যাওয়া এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের বিভীষিকা তাঁকে এমনভাবে তাড়া করে ফেরে যে, তিনি গত পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে ভাত খেতে পারেননি।

 

সুরজিৎ দাশ কথাগুলো বলছিলেন ১৯৭১ সালের ২১ মে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ঘটে যাওয়া 'পরকৌড়া গণহত্যা'-এর কথা স্মরণ করে। পাকিস্তানি হানাদারদের গুলিতে সেদিন ১৭৬ জন নিরীহ মানুষ শহীদ হয়েছিলেন।

 

 

নিজের জীবনের এই অদ্ভুত ও করুণ সত্যটি জানাতে গিয়ে সুরজিৎ দাশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন:

“চারদিকে রাস্তায় কুকুর-শিয়াল আর শকুন লাশ নিয়ে টানাটানি করছে। গর্ত খুঁড়ে কোনোমতে লাশগুলো মাটিচাপা দিয়েছি। ধর্মীয় রীতি মেনে সৎকারের সুযোগও পাইনি। সেদিন সেই ভয়ংকর দৃশ্য দেখার পর আর কখনো ভাত খেতে পারিনি। ভাত খেতে গেলে বমি আসে, চোখের সামনে বীভৎস সেই দৃশ্য ভেসে ওঠে। কলা-রুটি–বিস্কুট খেয়ে বেঁচে আছি।”

 

তাঁর এই কথাগুলো প্রমাণ করে, যুদ্ধের ট্রমা বা মানসিক আঘাত কত দীর্ঘ ও গভীর হতে পারে।

 

 

১৯৭১ সালের ২১ মে-এর সেই ভয়াবহ দিনে সুরজিৎ দাশের বাড়িতে ঢুকে তাঁর বাবা রমনীমোহন দাশসহ নয়জন স্বজনকে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তাঁর বাবা ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা মাস্টারদা সূর্য সেনের বিপ্লবী দলের একজন যোদ্ধা, যিনি সেই সময় ৮৫ বছর বয়সে শহীদ হন।

 

উচ্চমাধ্যমিক পাস করে স্নাতকে ভর্তি হওয়া সুরজিৎ দাশ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ২৫-৩০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল নিয়ে তাঁরা আনোয়ারার গ্রামে পাহারা দিতেন। কিন্তু ২১ মে-এর সেই তাণ্ডব থেকে তিনি তাঁর বাবা ও স্বজনদের রক্ষা করতে পারেননি। ঘটনার পর যখন বাড়ি ফেরেন, তখন উঠানে-রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাশ দেখে তিনি প্রায় উন্মাদ হয়ে যান।

 

সুরজিৎ দাশের প্রতিবেশী সজল ভট্টাচার্য নিশ্চিত করেছেন, বহু চেষ্টা করেও তাঁকে ভাত খাওয়ানো যায়নি। তিনি ৫৪ বছর ধরে কেবল কলা, রুটি ও বিস্কুট খেয়ে জীবনধারণ করে আসছেন।

এই বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবনে নেমে আসা এই স্থায়ী আঘাত আমাদের আবারও মনে করিয়ে দেয়, স্বাধীনতার জন্য জাতিকে কী ভয়ংকর মূল্য দিতে হয়েছিল। সুরজিৎ দাশের মতো অসংখ্য মানুষ আজও সেই সময়ের বীভৎস স্মৃতির ভার বহন করে চলেছেন।

এই বিভাগের আরো খবর