রোববার   ০২ নভেম্বর ২০২৫   কার্তিক ১৮ ১৪৩২   ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
১৭

মাদ্রাসা শিক্ষক নিয়োগে জালিয়াতি: সমাজকর্মে পড়েও বিজ্ঞানের প্রভাষক

তরুণ কণ্ঠ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২ নভেম্বর ২০২৫  

যশোর সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে রুদ্রপুর গ্রামের মাহিদিয়া সম্মিলনী মহিলা আলিম মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগে এমন এক জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে, যা রোমাঞ্চকর গল্পকেও হার মানাবে। তিনজন শিক্ষক সমাজকর্মে পড়াশোনা করেও হয়েছেন রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান ও উদ্ভিদবিজ্ঞানের প্রভাষক। তাদের একজন আবার স্নাতক পাসের দুই বছর আগেই স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। কেউ বাল্যবন্ধুর সনদ ব্যবহার করেছেন, কেউ আবার পুরুষের নিবন্ধন সনদে নারী শিক্ষক হিসেবে চাকরি করছেন।

 

তদন্তে আরও উঠে এসেছে, এ ধরনের ভয়াবহ জালিয়াতিতে জড়িয়ে পড়েছে খোদ মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরও। মাদ্রাসাটি আলিম স্তরের অনুমতি পাওয়ার পর ১৫ জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়। পরে অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তে দেখা যায়, ৯ জনের নিয়োগ বৈধ হলেও ৬ জনের নিয়োগে বড় জালিয়াতি হয়েছে। তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ করা হলেও পরবর্তীতে ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমে অধিদপ্তর আবারও চারজনের চাকরি বৈধ ঘোষণা করে।

 

রসায়নের প্রভাষক মুস্তাক আহমেদের জালিয়াতি ছিল সবচেয়ে বড়। তিনি অন্যজনের নামের মিল থাকা সনদ ব্যবহার করে সমাজকর্মের সার্টিফিকেটে বিষয় পরিবর্তন করে রসায়নের শিক্ষক হন। শুধু তাই নয়, স্কুল পর্যায়ের নিবন্ধন সনদ ঘষামাজা করে কলেজ পর্যায়ের সনদ বানিয়েও জমা দেন। এমনকি তার একাডেমিক তথ্য, ঠিকানা, ও পিতার নামেও মিল পাওয়া যায়নি।

 

একইভাবে সমাজকর্মে পড়ে পদার্থবিজ্ঞান ও উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষক হয়েছেন আরও দুজন—আব্দুল কাইয়ুম ও মাসুম পারভেজ। তদন্তে তাদেরও অনিয়ম ধরা পড়ায় বেতন-ভাতা বন্ধ করা হয়।

 

সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে গণিতের প্রভাষক নিয়োগে। দুজন তরিকুল ইসলাম নামের প্রার্থী আবেদন করেন। চতুর্থ হওয়া তরিকুল প্রথম হওয়া তরিকুলের সব সনদ ব্যবহার করে চাকরি পান। পরে বিষয়টি ফাঁস হলে তার ইনডেক্স বাতিল করা হয়, কিন্তু পরবর্তীতে অধিদপ্তর রহস্যজনকভাবে তার ইনডেক্স পুনর্বহালের উদ্যোগ নেয়।

 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক শারমিন আক্তার ব্যবহার করেছেন মো. শিমুল হোসেন নামে এক পুরুষ প্রার্থীর নিবন্ধন সনদ। সহকারী মৌলভি আমেনা খাতুন আসলে আসমা খাতুন—তিনি অন্য আসমা খাতুনের সনদপত্র ব্যবহার করে নিজের নাম পরিবর্তন করে চাকরি করছেন। তিনি আবার মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ফারুক হোসাইনের স্ত্রী।

 

অভিযোগ আছে, তদন্তে দোষ প্রমাণিত হওয়ার পরও অধ্যক্ষ ফারুক হোসাইন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে অভিযুক্ত শিক্ষকদের বেতন চালুর ব্যবস্থা করেন। এতে প্রায় অর্ধকোটি টাকার লেনদেন হয়েছে বলে জানা যায়।

 

অধিদপ্তরের উপপরিচালক (অর্থ) ড. কে এম শফিকুল ইসলাম জানান, “সবকিছু যাচাই-বাছাই করে আমার কাছে উপস্থাপন করা হয়েছিল। আমি শুধু স্বাক্ষর করেছি।” অন্য সদস্য ইসমাইল হোসেন বলেন, “তরিকুলের ইনডেক্স বাতিল হয়েছে, সেটি জানতাম না।”

 

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, “এত গুরুতর অভিযোগের পরও বেতন ছাড় দেওয়া ঠিক হয়নি। বিষয়টি নতুন করে তদন্ত করা হবে।”

 

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, “এমন জালিয়াতি শিক্ষার জন্য ভয়ংকর। সমাজকর্মে পড়ে বিজ্ঞানের শিক্ষকতা করছে, অথচ প্রশাসন বুঝতেও পারছে না—এটা প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও দুর্নীতির স্পষ্ট উদাহরণ।”

 


 

এই বিভাগের আরো খবর