রোববার   ১১ মে ২০২৫   বৈশাখ ২৭ ১৪৩২   ১৩ জ্বিলকদ ১৪৪৬

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
১৭১

ঘুমই হয়েছে শত্রু তার

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ২৪ নভেম্বর ২০১৮  

সুস্থ থাকার জন্য পর্যাপ্ত ঘুমের বিকল্প নেই। অনেকেই মনে করেন, ঘুমের চেয়ে শান্তির আর কিছু হয় না। ছুটির দিনে সকাল সকাল ওঠার তাড়া না থাকায় অনেকেই সারা সপ্তাহই অপেক্ষায় থাকেন ছুটির দিনের জন্য।

কিন্তু সেই ঘুমই আমার সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমার জীবনটা খুব গোছালো। আমি আমস্টারডামে আমার বয়ফ্রেন্ড ও দুই ফ্ল্যাটমেটের সঙ্গে থাকি, পারসোনাল ট্রেইনার হিসেবে কাজ করি। আমি কাজ করতে ভালোবাসি, বন্ধুদের সঙ্গে শপিং করতে আর বাইরে খেতে ভালোবাসি। এগুলো সবই খুব স্বাভাবিক। কিন্তু আমি কোনোভাবেই হঠাৎ করে ঘুমিয়ে পড়া ঠেকাতে পারি না।

আমার ন্যারকোলেপ্সি (এক ধরনের রোগ যার কারণে ঘুমের সময়ের কোনো স্বাভাবিক ধারা থাকে না, আক্রান্ত ব্যক্তি যেকোনো জায়গায়, যেকোনো কাজের মধ্যে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়তে পারেন) রয়েছে। যার কারণে, আমাদে দিনে আট থেকে ৯বার ঘুমাতে হয়। কখনও কখনও কোথাও বসে থাকা অবস্থায়ও আমি ঘুমিয়ে যায়, সেটা হয়তো ১০ সেকেন্ড স্থায়ী হয়। প্রায়ই এমন হয় সেটা আমি টেরও পায় না। আর অন্য সময়গুলোতে কোনো অনুভূতি জোরদার হলেই দুর্বল হয়ে পড়ে শরীরের পেশি। তখন আমি আর জেগে থাকতে পারি না।

আর সবকিছুর পরে রাতে আমি যখন ঘুমাতে চাই তখন আর ঘুমাতে পারি না।

কেউ যখন শোনে আমি ন্যারকোলেপ্টিক তখন তারা বলে, তাদেরও এমন ক্লান্তি লাগে, কাজের মধ্যে ঝিমুনি আসে। আসলে তারা মনে করে, আমার যা হয় সেটা তাদেরও হয়। কিন্তু বিষয়টা আসলে শুধু ক্লান্ত হওয়াই নয়। ক্লান্ততো প্রত্যেকেই হয়। আমারটা ভিন্ন মাত্রার।

এই ন্যারকোলেপ্সির জন্য আমি শুধু যখন-তখন ঘুমিয়েই পড়ি না। এরজন্য আমি অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ডও করে ফেলি। দেখা যাবে রাতে খাবার টেবিলে বসে আমার হয় ‘স্লিপ অ্যাটাক’ হলো- তখন ভুল বকতে শুরু করি, উল্টো-পাল্টা কাজ করি, দেখা যাবে- আমি প্লেট থেকে খাবার নিয়ে মুখে না নিয়ে টেবিলের ওপর রাখছি।

১৫ বছর বয়সে আমি ন্যারকোলেপ্সিতে আক্রান্ত হতে শুরু করি। আমি সেই সব বিরল মানুষদের একজন, সোয়াইন ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়ার কারণে যাদের মধ্যে এটা তৈরি হয়।

আমার স্কুলে কয়েকজন একসঙ্গে সোয়াইন ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিল। প্রথমদিকে সেটা স্বাভাবিকই ছিল, কিন্তু মাস ছয়েক পর দেখা গেল বিভিন্ন সময় আমি ঘুমিয়ে পড়ছি, আর চাইলেও সেটা ঠেকানো যাচ্ছে না। প্রথমদিকে আমি কিছু খেয়াল করিনি। সপ্তাহে একবার বা দু;বার এমন হতো। কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারে সেটা আসলে ন্যারকোলেপ্সির প্রাথমিক পর্যায় ছিল। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছিল। আর যখন আমি বুঝতে পারলাম আসলে কী হচ্ছে আমার সাথে, ততদিনে আমি স্কুলে প্রতিটা ক্লাসেই একবার ঘুমিয়ে যেতাম। তখন আমার বয়স মাত্র ১৬ বছর, রাতে আমি অন্তত ৮ ঘণ্টা করে ঘুমাতাম। তারপরও আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না, কেন আমি জেগে থাকতে পারি না।

আমার বন্ধুরা প্রথমদিকে এটা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করলেও পরে তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করে, আমি আসলে সুস্থ আছি কি না। এরপর আমাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।

বয়স কম হওয়ার কারণে প্রথমদিকে আমাকে তারা কোনো ওষুধ দিতে চাচ্ছিল না। বরং আসলে কোনোভাবে রাতে জেগে থাকি কি না, সেটাই নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন তারা। তারপর ১৭ বছর বয়সে শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকরা আমরা রোগটা ধরতে পারলেন।

প্রথমে আমাকে যে ওষুধ দেয়া হয়েছিল তাকে কয়েকদিন আমি ভালোই ছিলাম। কিন্তু কিছু দিন পরই দেখা গেল এতে আমার আর কাজ হচ্ছে না।

আনুষ্ঠানিকভাবে যখন আমার ন্যারকোলেপ্সির চিকিৎসা শুরু হলো আমি স্কুল ছেড়ে দিলাম। আমি পড়াশোনার চেষ্টা করতাম, কিন্তু মনোযোগ দেয়াটা অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। সারাটা জীবন আমি কিভাবে চলবো তা ভেবেই আমি ভয় পাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম, যখন আমার মা থাকবে না তখন আমার কী হবে? কারণ, আমার জীবনে মা-ই তখন একমাত্র মানুষ যে আমাকে ঠিকঠাক বুঝতো। আমি খুব একা হয়ে গিয়েছিলাম।

এভাবেই চলছিল। তারপর আমি খেয়াল করলাম দিনে যদি ঘণ্টা দুয়েকের জন্য দৌড়াই আমার বেশ ভালো লাগে। তারপর আমার মায়ের সঙ্গে আলাপ করে আমি পারসোনাল ট্রেইনার হিসেবে কাজ শুরু করি। কাজ করতে শুরু করার পর আমার জীবনটা কিছুটা বদলেছে।

আমার বয়ফ্রেন্ড মাইকেলের সঙ্গে প্রথম দেখা হয় তিন বছর আগে। রাতে খাবার টেবিলে একদিন মাইকেলের যমজ ভাই নিক আমার ‘স্লিপ অ্যাটাক’ দেখে। আমি আমার প্লেট থেকে পিজ্জা নিয়ে মায়ের প্লেটে রাখছিলাম। পরে মাইকেল আমার কাছে জানতে চায় আমার আসলে সমস্যাটা কী। তাকে বলার পর সে এ ব্যাপারে আরও জানতে আগ্রহী হয়। সবকিছু জানার পর থেকে এখনও পর্যন্ত সে এ বিষয়টা নিয়ে আমার সাথে কোনোদিন খারাপ ব্যবহার করেনি। অন্য মানুষ কী ভাবছে তা নিয়েও ও কিছু ভাবে না।

এর আগে যাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়েছিল তারা এভাবে আমাকে বোঝেনি।

একবার আমি আমার সঙ্গে একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে খাওয়ার টেবিলে আমার ‘স্লিপ অ্যাটাক’ হয়, আর আমি আমার প্লেট থেকে ব্রোকোলি নিয়ে সুন্দর করে আমার ফোনের ওপর রাখতে শুরু করি। টেবিলের সবাই বলতে শুরু করে, বেল মাতাল হয়ে এমন করছে। আমার ভিডিও করতে শুরু করে অনেকে। আমি এত বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে, আমি যা করেছি এর ওপর আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু আমার কথা কেউ বিশ্বাস করেনি। সবাই শুধু হাসছিল।

আমি যখন খাই তখনই যে কেবল আমার ‘স্লিপ অ্যাটাক’ হয় তা নয়, যখন আমার মাসিক চলে বা কোনো কিছু নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকি তখনও একই অবস্থা হয়।

আমরা বাইরে কোথাও খেতে গেলে মাইকেল খুব সুন্দরভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে। সে আমাকে বলে, টেবিলে মাথা রেখে পাঁচ মিনিটের জন্য ঘুমিয়ে নিতে। আর ওই সময়টাতে ও খুব স্বাভাবিক আচরণ করে। যতক্ষণ আমি ঘুম থেকে না উঠি, ও হয়তো ফোনে কিছু পড়ে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢু মারে। ওর এই ভূমিকাটাই এখন আমার জন্য সব।

আমার এ অবস্থার জন্য অনেকের দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি অনেক সময়ই বিব্রত বোধ করি। ছোটবেলায় যদি কেউ আমাবে বলতো আমাকে দিনে আটবার ঘুমাতে হবে! এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারতো! ন্যারকোলেপ্সি খুব বাজে একটা রোগ হলেও আমি এক্সাসাইজের মাধ্যমে এর মধ্যেই ভালোভাবে বেঁচে থাকার একটা উপায় খুঁজে নিয়েছি। এ রোগের বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা রয়েছে। তবে আমার জন্য এটাই কাজ করেছে।

আর তাছাড়া আমার মাইকেল রয়েছে। আমি কখনও ভাবিনি এমন একটা মানুষের সঙ্গে আমার কখনও পরিচয় হবে।

আমি জানি আমি কখনও এ যুদ্ধটা জিতব না। কারণ ন্যারকোলেপ্সি থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায় এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু আমি যতক্ষণ জেগে আছি, আমি জানি জীবনটা পুরোপুরি উপভোগ করছি আমি। এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় বিষয়।

এই বিভাগের আরো খবর