সোমবার   ১৩ অক্টোবর ২০২৫   আশ্বিন ২৮ ১৪৩২   ২০ রবিউস সানি ১৪৪৭

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
২০

ক্যাডারদের দ্বন্দ্বে আটকে আছে প্রশাসনিক সংস্কার

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৩ অক্টোবর ২০২৫  

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ২০৮ সুপারিশের মধ্যে আশু বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ১৮টি। এর মধ্যে মাত্র তিনটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এর বাইরে ছয়টি সুপারিশ যুক্ত করা হয়েছে জুলাই সনদে। 

গত ২২ মে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ, বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বৈঠক হয়। বৈঠকে তিন পক্ষ মিলে একটি যৌথ সুপারিশ দেওয়ার পরামর্শ দেয় ঐকমত্য কমিশন। 

পরামর্শ অনুযায়ী, গত ৩০ জুন তিন পক্ষ একসঙ্গে আলোচনায় বসলেও কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। ফলে জনস্বার্থমূলক অনেক সুপারিশও বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। 

বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ঐকমত্য কমিশনের পরামর্শে সব ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রতিনিধি একসঙ্গে বসেছিলেন। তবে ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা যেভাবে বক্তব্য দেন, তা শৃঙ্খলা পরিপন্থি। তাই সংস্কারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। 

আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক মুহম্মদ মফিজুর রহমান সমকালকে বলেন, তিন পক্ষের আলোচনার শুরুতেই বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা শর্ত দেন, উপসচিব পুলের কোটা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের রিভিউ মামলা প্রত্যাহার না করলে তারা আমাদের সঙ্গে সংস্কার বিষয়ে কোনো আলোচনা করবেন না। অথচ, ওই মামলাটি জনপ্রশাসন সংস্কারেরই অংশ। এ ছাড়া মামলাটি আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ করেনি; বিভিন্ন ক্যাডারের কয়েক সদস্য এ মামলা করেছেন। যেটি আদালতে বিচারাধীন, সেটি বাদে অন্য বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য প্রস্তাব ও অনুরোধ করলেও তারা কোনোভাবে রাজি হননি। প্রশাসন ক্যাডারের সহকর্মীদের এমন আচরণের কারণে আলোচনা ভেস্তে যায়। 

বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মো. আনিসুজ্জামান সমকালকে বলেন, ক্যাডার কর্মকর্তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বসেছিলাম। এর পরও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

সংস্কার আটকে যাওয়ার কারণ উপসচিব পদ

উপসচিব পদে কোটা পদ্ধতি বহাল রাখার ব্যাপারে সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এর মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ এবং বাকি ৫০ শতাংশ পদ অন্য ২৫টি ক্যাডারের জন্য উন্মুক্ত থাকার কথা বলা হয়। আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ বলছে, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রশাসন ক্যাডারের ছয় হাজার কর্মকর্তার জন্য ৫০ শতাংশ এবং বাকি ২৫টি ক্যাডারের প্রায় ৬০ হাজার কর্মকর্তার জন্য ৫০ শতাংশ কোটা ভাগাভাগির প্রস্তাব বৈষম্যমূলক। একই সঙ্গে তারা পরীক্ষার মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে উপসচিব নিয়োগের সুপারিশ করেছে। 

প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা বলছেন, উচ্চ আদালতের রায়ের ভিত্তিতে উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৭৫ শতাংশ ও অন্য ক্যাডার থেকে ২৫ শতাংশ নেওয়া হয়। এটা মীমাংসিত বিষয়। এ ব্যাপারে নতুন করে ভিন্ন সুপারিশ প্রস্তাবের বিষয়টি আমাদের উৎকণ্ঠা বাড়িয়েছে। 

সাবেক সচিব, জনপ্রশাসন সংস্কার ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া সমকালকে বলেন, দুপক্ষের মাঝামাঝি আমরা একটি নিরপেক্ষ সুপারিশ করেছি। যাতে সমাধানে আসা যায়। 

আরও ১৭ সুপারিশ 

ক্যাডার কর্মকর্তারা একমত না হলেও আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ ও বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন উপসচিবের পদ ছাড়াও আরও ১৭ বিষয়ে যৌথ সুপারিশ দিয়েছে ঐকমত্য কমিশনে। সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে তারা বিকল্প সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে বদলি, পদায়ন, পদোন্নতি কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের মাধ্যমে করা, প্রেষণে কর্মকর্তা নিয়োগ, সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস, বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, জেলা পরিষদ বিলুপ্তি, সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ি কেনার ঋণ, সব ক্যাডারের লাইন পদোন্নতি নিশ্চিত করা, বিভিন্ন সার্ভিসের লাইন পদোন্নতির প্রস্তাব, পদোন্নতি না পেলে বেতন সুবিধা, জনপ্রশাসনে ক্যারিয়ার পরিকল্পনা, ইউএনওর দায়িত্ব নির্ধারণ এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, হিসাব ও নিরীক্ষা, ডাক, পরিসংখ্যান, পরিবার পরিকল্পনা ক্যাডারের বিষয়ে সুপারিশ। সর্বশেষ প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থার প্রস্তাব। 

সাবেক সচিব এ কে এম আব্দুল আউয়াল মজুমদার সমকালকে বলেন, প্রশাসনিক সংস্কারবিষয়ক প্রতিবেদন সুচিন্তিত ও বাস্তবভিত্তিক হয়েছে বলে কোনো পক্ষই মনে করে না। ফলে এ প্রতিবেদন কোনো পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তা ছাড়া ক্যাডারগুলোর মধ্যে ন্যূনতম পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ নেই, চাহিদারও লাগাম নেই। সব ক্যাডারে অযৌক্তিক চাহিদা বিদ্যমান। কারও দাবিতেই বাস্তবতা নেই। তিনি বলেন, এ বিষয়টি রাজনৈতিক সরকারের জন্য রেখে দেওয়াই ভালো হবে।

জুলাই জাতীয় সনদে জনপ্রশাসনের ছয় প্রস্তাব নিয়েও মতানৈক্য

৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে তৈরি হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ। তবে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে জনপ্রশাসন সম্পর্কিত সুপারিশ রয়েছে ছয়টি। এই ছয় সুপারিশ নিয়েও মতানৈক্য রয়েছে ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে। 

সুপারিশগুলো হলো গণহত্যা ও ভোট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন, স্বাধীন ও স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন, সরকারি কর্ম কমিশনকে তিন ভাগ করা, হিসাব বিভাগ থেকে নিরীক্ষা বিভাগ আলাদা করা, কুমিল্লা ও ফরিদপুর নামে দুটি প্রশাসনিক বিভাগ ও স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন। 

আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ ও বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বলছে, বিসিএস হিসাব ও নিরীক্ষা সার্ভিসকে আগের মতো এক রাখা যুক্তিযুক্ত। এ ছাড়া পিএসসিকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। প্রয়োজনে বাড়াতে হবে জনবল। এ বিষয়ে দুপক্ষ ঐকমত্য কমিশনে লিখিত প্রস্তাব দিয়েছে। 

বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নজরুল ইসলাম বলেন, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো প্রশাসনের যেসব সংস্কারের বিষয়ে একমত হয়, সে বিষয়ে আমাদের কোনো বিরোধিতা নেই। যদি প্রশাসন ক্যাডারের ক্ষতির কারণ হয়, তখন আমরা শৃঙ্খলার সঙ্গে যৌক্তিকতাসহ আলোচনা করব। সরকারের কাছে বিষয়গুলো তুলে ধরব।

আশু বাস্তবায়নযোগ্য ১৮ সুপারিশ 

আশু বাস্তবায়নযোগ্য ১৮ সুপারিশের মধ্যে মহাসড়কের ফিলিং স্টেশনে স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার, নাগরিকের পাসপোর্ট পাওয়ার মৌলিক অধিকার এবং গণশুনানির বিষয়টি বাস্তবায়ন হয়েছে। 

বাস্তবায়ন না হওয়া বাকি ১৫টি সুপারিশ হলো মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট গতিশীল করা, কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন, কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালনা, তথ্য অধিকার আইন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পুনর্গঠন এবং ডিজিটাল রূপান্তর ও স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন, এনবিআর পুনর্গঠন, বাংলাদেশ বিনিয়োগ ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ভূমি রেজিস্ট্রেশন অফিস সংস্কার, উপজেলা পরিষদ শক্তিশালী করা, পার্শ্বনিয়োগ, পদোন্নতি না পেলে বেতন সুবিধা, স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন এবং পুলিশ ভেরিফিকেশন। 

নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান ও ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার সমকালকে বলেন, দুর্ভাগ্যবশত জনপ্রশাসনের সমস্যা সমাধানে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না। কারণ, ক্যাডার কর্মকর্তারা কোনো বিষয়ে একমত হতে পারেননি। তিনি বলেন, আমরা চাই কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সমস্যাগুলোর সমাধান হোক। 

জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে গত বছরের ৩ অক্টোবর জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। গত ৮ ফেব্রুয়ারি কমিশনপ্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। 

এই বিভাগের আরো খবর