শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১   ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
৫৪০

প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুআ ও আমল

প্রকাশিত: ৩ মে ২০১৯  

প্রকৃতি মহান আল্লাহর মহা দান। তিনি প্রকৃতি সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষের বসবাসের উপযোগী করে প্রকৃতিকে সুশৃঙ্খল করেছেন। প্রকৃতির যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা তাঁরই অধীনে। তবু কখনো প্রকৃতি বিরূপ রূপ ধারণ করে। রূঢ় ও রুষ্ট হয়, যাকে আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে থাকি। যেমন ঘূর্ণিঝড়, কালবৈশাখী ঝড়, শিলাবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস, ভারী বর্ষণ, বন্যা, খরা, দাবানল, শৈত্যপ্রবাহ; দুর্ভিক্ষ, মহামারি, ভূমিকম্প, সুনামি প্রভৃতি।

ইনশাআল্লাহ, এ নিবন্ধে এমন দুর্যোগকালীন সময়গুলোতে আমাদের জন্য নবীজির বলে যাওয়া পাঠ্য দুআ ও করণীয় আমল তুলে ধরা হবে।

এক. দুর্যোগে বিচলিত না হয়ে ধৈর্য ধারণ করা
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কিছু কিছু বিপদ-আপদ ও বালা-মুসিবত দিয়ে মানুষকে সতর্ক করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِّنَ الْخَوفْ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِّنَ الأَمَوَالِ وَالأنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ . الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُم مُّصِيبَةٌ قَالُواْ إِنَّا لِلّهِ وَإِنَّـا إِلَيْهِ رَاجِعونَ

‘আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান, মাল ও ফলফলাদির ক্ষতির মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। যারা, নিজেদের বিপদ-মুসিবতের সময় বলে, “নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা আল্লাহরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী”, তাদের ওপরই রয়েছে তাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও রহমত এবং তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত।’ –সূরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫-১৫৭

দুই. দুর্যোগের সময় করণীয় সুন্নত আমল
প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় কিছু সুন্নত আমল করার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচার সুযোগ রয়েছে। বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, যখন কোথাও ভূমিকম্প হয় অথবা সূর্যগ্রহণ হয়, ঝড়ো বাতাস বা বন্যা হয়, তখন সবার উচিত মহান আল্লাহর কাছে তওবা করা, তাঁর কাছে নিরাপত্তার জন্য দুআ করা, মহান আল্লাহকে স্মরণ করা এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা। এ ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (সা.) নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘দ্রুততার সঙ্গে মহান আল্লাহর যিকির করো, তাঁর নিকট তওবা করো।’ –বুখারী ২/৩০; মুসলিম ২/৬২৮

আল্লাহর যিকিরের সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে নামায পড়া, কুরআন তিলাওয়াত বা দুআ-দরুদ পাঠ করা। দুর্যোগের সময় যিকিরের আরও উপায় হতে পারে ইস্তিগফার, তাসবীহ পাঠ ইত্যাদি। হাদীস শরিফে বর্ণিত আছে, প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়া বইলে রাসুলুল্লাহ (সা.) মসজিদে যেতেন এবং নামাযে মশগুল হতেন। –মিশকাতুল মাসাবীহ: ৬৯৬

সাহাবাদের জীবনে আমরা দেখি, বিপদে-মুসিবতে তাঁরা নামাযে দাঁড়াতেন ও ধৈর্য ধারণ করতেন। –মিশকাতুল মাসাবীহ: ৫৩৪৫

ঝড়-তুফানের প্রাদুর্ভাব ঘটলে তাকবির তথা ‘আল্লাহু আকবার’ (আল্লাহ মহান) বলা ও আযান দেওয়া সুন্নত। (তবে এই আযানে ‘হাইয়া আলাস সলাহ’ (নামাযের জন্য আসো) ও ‘হাইয়া আলাল ফালাহ’ (সফলতার জন্য আসো) বাক্যদ্বয় বলার প্রয়োজন নেই)।

তিন. প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচার উপায়
আল্লাহ তাআলা মানুষকে আশরাফুল মখলুকাত হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। তিনি অযথা কাউকে শাস্তি দিতে চান না। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ হলো আল্লাহ তাআলার অসন্তুষ্টি। আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচার জন্য আমল পরিশুদ্ধ করতে হবে। যে আমলে আল্লাহ খুশি হন, সে আমল বেশি বেশি করতে হবে। নামায, কুরআন তিলাওয়াত, দান-সদকা ইত্যাদি ভালো কাজ করতে হবে। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, ‘সদকা আল্লাহর অসন্তুষ্টিকে নিভিয়ে দেয় এবং অপমৃত্যু রোধ করে।’ –সুনানে তিরমিযী: ৬০০

সাধারণ বৃষ্টি-বাদলের সময় ও বৃষ্টির পর পড়ার সুন্নত দুআ
হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) বর্ণনা করেন, বৃষ্টি হলে রাসুলুল্লাহ (সা.) এই দুআ পড়তেন:
اللَّهُمَّ صَيِّبًا نَافِعًا 
উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা ছয়্যিবান নাফিআ’। 
অর্থ: হে আল্লাহ! এই বৃষ্টি যেন আমাদের জন্য উপকারী ও কল্যাণকর হয়।’ –বুখারী, হাদীস: ৯৮৫

হযরত যায়েদ ইবনে ছাবিত (রা.) বর্ণনা করেন, বৃষ্টির পর রাসুলুল্লাহ (সা.) বলতেন:
 مُطرنا بفضل الله ورحمته 
উচ্চারণ: মুতিরনা বি-ফাদলিল্লাহি ওয়া রাহমাতিহি। 
অর্থ: ‘আল্লাহ তাআলার দয়া ও অনুগ্রহে আমরা বৃষ্টিস্নাত হয়েছি।’ –বুখারী ও মুসলিম, হাদীস: ৭১-মুসলিম

ভারী বর্ষণ ও অতিবৃষ্টির সময় পড়ার সুন্নত দুআ:
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) অধিক বৃষ্টি ও ভারী বর্ষণের সময় এই দুআ পড়তেন,

اللهم حوالينا ولا علينا، اللهم على الآكام والظِّرَاب وبطون الأودية ومنابت الشجر

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা হাওয়ালাইনা ওয়া লা আলাইনা, আল্লাহুম্মা আলাল আ-কামি ওয়ায-যিরাবি ওয়া বুতুনিল আওদিয়াতি ওয়া মানাবিতিশ শাজারি।
অর্থ: হে আল্লাহ! এই ঝড়, তুফান ও ভারী বর্ষণ আমাদের আশপাশ থেকে সরিয়ে নিন, দয়া করে আমাদের ওপর ঝড়, তুফান ও ভারী বর্ষণ দেবেন না। হে আল্লাহ, এই ভারী বর্ষণ দিন টিলা-পর্বতে, উঁচু ভূমিতে, উপত্যকায়, বনভূমি ও চারণ ভূমিতে। –বুখারী ও মুসলিম, হাদীস: ৯৬৮-বুখারী

ঝড়-তুফানের সময় পড়ার সুন্নত দুআ
হযরত আয়িশা সিদ্দিকা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ঝড়-তুফানের সময় এর ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে এই দুআ পড়তেন-

اللهم إني أسألك خيرها ، وخير ما فيها ، وخير ما أُرسلت به ، وأعوذ بك من شرها وشر ما فيها وشر ما أرسلت به

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নী আসআলুকা খাইরাহা ওয়া খাইরা মা ফী-হা ওয়া খাইরা মা আরসালতা বিহী, ওয়া আউযু বিকা মিন শাররিহা ওয়া শাররি মা ফী-হা ওয়া শাররি মা আরসালতা বিহী।
অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করি এই ঝড়ের কল্যাণ, এর মধ্যস্থিত কল্যাণ, এর সঙ্গে প্রেরিত কল্যাণ। আমি আপনার নিকট পানাহ চাই এই ঝড়ের অনিষ্ট থেকে, এর মধ্যস্থিত অনিষ্ট থেকে, এর সঙ্গে প্রেরিত অনিষ্ট থেকে। –বুখারী ও মুসলিম, হাদীস: ১৫০২-মুসলিম

বজ্রপাত, ঝড়-তুফান ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচার বিশেষ দুআ
প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহ করুণ এক রূপ হলো বজ্রপাত, যা মহান রাব্বুল আলামিনের শক্তিমত্তা ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। এ সম্পর্কে কুরআনুল কারীমে এসেছে-

وَيُسَبِّحُ الرَّعْدُ بِحَمْدِهِ وَالْمَلاَئِكَةُ مِنْ خِيفَتِهِ وَيُرْسِلُ الصَّوَاعِقَ فَيُصِيبُ بِهَا مَن يَشَاء وَهُمْ يُجَادِلُونَ فِي اللّهِ وَهُوَ شَدِيدُ الْمِحَالِ

‘বজ্রধ্বনি তাঁর সপ্রশংস মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করে, ফেরেশতাগণও তাঁকে ভয় করে (প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা করে)। তিনি বজ্রপাত ঘটান এবং যাকে ইচ্ছা তা দ্বারা আঘাত করেন। আর তারা আল্লাহ সম্পর্কে বিতণ্ডা করে, অথচ তিনি মহা শক্তিশালী।’ –সূরা রাআদ, আয়াত: ১৩

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেন, বজ্রপাত ও বিজলি চমকানোর সময় এর ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে রাসুলুল্লাহ (সা.) এই দুআ পড়তেন-

اللَّهُمَّ صَيِّبًا نَافِعًا، اللَّهُمَّ صَيِّبًا هَنِيئًا، اللهم لا تقتلنا بغضبك، ولا تهلكنا بعذابك، وعافنا قبل ذلك

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ছায়্যিবান নাফিআ, আল্লাহুম্মা ছায়্যিবান হানীআ। আল্লাহুম্মা লা তাকতুলনা বি-গদাবিকা, ওয়া লা তুহলিকনা বি-আযাবিকা ওয়া আ-ফিনা ক্বাবলা যা-লিকা।
অর্থ: হে আল্লাহ! গজব দিয়ে আমাদের নিঃশেষ করবেন না, আযাব দিয়ে আমাদের ধ্বংস করবেন না; এর পূর্বেই আমাদের ক্ষমা করে দিন। –বুখারী, হাদীস: ৭২১; মিশকাত, হাদীস: ১৫২১; তিরমিযী, হাদীস: ৩৪৫০; নাসাঈ, হাদীস: ৯২৭; আহমাদ, হাদীস: ৫৭৬৩