কারাগারে টাকা দিলেই মুঠোফোন
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত : ০৯:৪৭ এএম, ৭ ডিসেম্বর ২০২৫ রোববার
দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই কেন্দ্রীয় কারাগার—কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এবং গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার—থেকে বন্দীরা অবৈধভাবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে বাইরের চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করছেন। পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এক চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এসবি'র তথ্যপ্রযুক্তি নজরদারিতে দেখা গেছে, এই দুটি কারাগারের দুর্ধর্ষ বন্দীরা অন্তত ৩৬০টি অবৈধ মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহার করছেন। এর পেছনে একশ্রেণির অসাধু কারাসদস্যের যোগসাজশ রয়েছে।
| কারাগার | অবৈধভাবে ব্যবহৃত নম্বর |
| কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার | ২৮১টি |
| ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার (কেরানীগঞ্জ) | ৭৯টি |
| মোট | ৩৬০টি |
পুলিশের প্রতিবেদন এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, কারাগারের অভ্যন্তরে মোবাইল ফোন ব্যবহার হচ্ছে অর্থের বিনিময়ে এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য।
অপরাধ ও অরাজকতা নিয়ন্ত্রণ
-
চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস: কারাবন্দী শীর্ষ সন্ত্রাসী ও আলোচিত অপরাধীরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বাইরের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ পরিচালনা এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন।
-
হত্যার হুমকি: কাশিমপুর কারাগারে বন্দী থাকাবস্থায় এক আসামি তাঁর মামলার বাদীকে হত্যার হুমকিও দিয়েছিলেন।
-
রাজনৈতিক নির্দেশনা: কিছু বন্দী অবৈধভাবে ফোন ব্যবহার করে বাইরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন এবং রাজনৈতিক নির্দেশনা দিচ্ছেন।
-
পলায়নের চেষ্টা: আটক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিরা কারাগার ভেঙে পালানোরও পরিকল্পনা করেছিলেন। এর অংশ হিসেবে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার ঘটনাও ধরা পড়েছে।
অর্থ ও সিগারেটের বিনিময়ে সুবিধা
কারামুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিয়মের বাইরে যেকোনো সময় কথা বলার জন্য টাকা খরচ করতে হয়।
-
টাকার অঙ্ক: কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা দিলেই ১০-১৫ মিনিট পর্যন্ত কথা বলার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।
-
বিকল্প মুদ্রা: কারাগারে নগদ টাকা ব্যবহার করা যায় না। তাই পুরুষ সেলগুলোতে অবৈধ লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে সিগারেটের প্যাকেট ব্যবহৃত হয় (যেমন: বেনসন ৪০০ টাকা, গোল্ডলিফ ৩০০ টাকা হিসেবে বিবেচিত হয়)।
কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন স্বীকার করেছেন যে একশ্রেণির অসাধু কারারক্ষী এবং পুরোনো বন্দীরা এই চক্রের সঙ্গে জড়িত।
-
শরীরে লুকিয়ে: অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছোট আকারের মোবাইল ফোনগুলো বিশেষ কায়দায় পায়ুপথে বা শরীরের বিভিন্ন অংশে লুকিয়ে ভেতরে ঢোকানো হয়। এমন ঘটনাও ঘটেছে যেখানে একজন বন্দী একসঙ্গে দুটি ফোন এনেছেন।
-
নিক্ষেপ ও উপহার: বাইরে থেকে মাদক ও মোবাইল ফোন বিশেষ কায়দায় পেঁচিয়ে বলের মতো করে ভেতরে নিক্ষেপ করা হয়। এছাড়াও খাবার, ওষুধ, জুতা বা উপহারের মধ্যে কৌশলে মোবাইল সেট ও সিম কয়েদিদের কাছে পৌঁছানো হয়।
-
লুকানোর স্থান: বন্দীরা শৌচাগার, গোসলখানা, কমোডের ফ্লাশ পাইপ বা দেয়ালে কুঠুরি তৈরি করে মোবাইল ফোন লুকিয়ে রাখেন।
কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জানিয়েছেন, বডি স্ক্যানার মেশিন নষ্ট থাকায় সমস্যা হচ্ছে এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এসবি'র প্রধান সুপারিশসমূহ:
-
জ্যামার ব্যবহার: কারাগারের ভেতরে কার্যকরী মোবাইল ফোন জ্যামার স্থাপন, আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ করা।
-
প্রযুক্তি উন্নত করা: সিসি ক্যামেরা পর্যবেক্ষণ ও স্ক্যানার প্রযুক্তি উন্নত করা এবং তল্লাশি জোরদার করা।
-
জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা: অসৎ কারারক্ষী ও কর্মচারীদের শনাক্ত করে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
-
ভেটিং: জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে কারাগারের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মচারীদের ভেটিং (নিরাপত্তা পরীক্ষা) করা।
কারা মহাপরিদর্শক মোতাহের হোসেন জানিয়েছেন, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, জনবল ও প্রশিক্ষণের ঘাটতির কারণে এবং অতীতে অনুপযুক্ত লোক নিয়োগের কারণে এই সমস্যা শূন্যে নামিয়ে আনা কঠিন হচ্ছে।
