শনিবার   ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫   অগ্রাহায়ণ ২২ ১৪৩২   ১৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৭

ঘুষ-জালিয়াতির মামলায় চাপ বাড়ছে, ক্ষমা চাইলেন নেতানিয়াহু

রাফিউল ইসলাম তালুকদার

প্রকাশিত : ০৫:০৭ পিএম, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫ শনিবার

ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার বিরুদ্ধে চলমান দুর্নীতির মামলা সমাপ্ত করার লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগের নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চেয়েছেন।
২০১৯ সালে শুরু হওয়া তিনটি পৃথক মামলায় ঘুষ, জালিয়াতি ও আস্থাভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

 

ইসরাইলের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘসময় দায়িত্ব পালনকারী নেতা হওয়া সত্ত্বেও, একইসঙ্গে তিনি প্রথম ব্যক্তি যিনি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় এ ধরনের ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি হয়েছেন। দোষী
সাব্যস্ত হলে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডের খড়গ নেমে আসতে পারে তার ওপর।

 

যদি তিনি কারাদণ্ড এড়িয়েও যান, তবুও যেকোনো একটিতে দোষী প্রমাণিত হলে তার রাজনৈতিক জীবনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের
আশঙ্কাও রয়েছে।


নেতানিয়াহু বরাবরের মতো অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন এবং এগুলোকে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের
সাজানো “উইচ-হান্ট” বলে উল্লেখ করেছেন। দেশজুড়ে যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেও তিনি জাতীয় ঐক্যের ডাক
দিয়েছেন।


ইসরাইলের গাজায় গণহত্যা অভিযানের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) তার বিরুদ্ধে
যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের আরেকটি তদন্ত চলমান থাকায় মামলাগুলো বছরের পর বছর বিলম্বিত
হয়েছে।

 

তিন মামলার সারসংক্ষেপ

 

গিফটস আফেয়ার খ্যাত কেস ১০০০ মামলায় নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে
আরনন মিলচান ও অস্ট্রেলিয়ান ব্যবসায়ী জেমস প্যাকার তাকে সিগার, শ্যাম্পেনসহ প্রায় ৭ লাখ শেকেল
(ইসরায়েলীকারেন্সী) মূল্যের নানা উপহার দেন । মিলচান ও প্যাকার উপহার দেয়ার কথা আদালতে স্বীকারও
করেন।

 

অন্য আরো একটি মামলায় দাবি করা হয়, নেতানিয়াহু ইয়েদিওত আহরোনোত পত্রিকার প্রকাশক আরনন
মোজেসের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছেছিলেন, বিনিময়ে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী পত্রিকার প্রচার সীমিত করার আইন
প্রণয়নে সহায়তা করতেন। একটি রেকর্ডকৃত বৈঠকে মোজেস নেতানিয়াহুকে বলেন: “ধরা যাক, আপনি এবং
আমি যে আইন নিয়ে একমত হয়েছি, সেই আইনের বাস্তবায়নে আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব যাতে আপনি
আপনার ইচ্ছামতো যতদিন চান ততদিন দায়িত্বে থাকেন।” কিন্তু নেতানিয়াহুর দাবি, তিনি এটিকে ঘুষ বা
নির্দিষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি হিসেবে নেননি।


তবে নেতানিহুর বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বর অভিযোগটি কেস ৪০০০-এ, বেজেক টেলিকমকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে
ওয়ালা নিউজে অনুকূল কভারেজ নেয়ার চেষ্টা করেন। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল বেজেক-ইয়েস একীভূতকরণের
অনুমোদন। এর বিপরিতে ওয়ালা নিউজে কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেয়ার অভিযোগ ওঠে, যদিও অভিযুক্ত
সকলেই এই অভিযোগ অস্বীকার করছেন।


গত তিন দশকে নেতানিয়াহুকে ঘিরে বহু অভিযোগ উঠেছে। ১৯৯৭ সালের অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ, ২০০১
সালের বাড়ি সংস্কার কেলেঙ্কারি, ২০১১ সালের বিদেশ সফরে সরকারি অর্থ ব্যয়, ২০১৫ সালের কেস ১২৭০
কিংবা ফরাসি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অনুদানের অভিযোগ; সবই কোনো না কোনো পর্যায়ে এসে খারিজ হয়ে গেছে।
তবে কখনোই বর্তমান মামলাগুলোর মতো গভীর বিচারিক প্রক্রিয়ায় গড়ায়নি।


চলমান মামলার শুনানি ২০২০ সালে প্রাথমিক শুরু হয়। ২০২১-২৫ পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণ, জেরা, পুলিশি
স্পাইওয়্যার ব্যবহারের অভিযোগসহ নানা জটিলতা মামলাকে দীর্ঘায়িত করেছে। জুন ২০২৫ থেকে তার জেরা
শুরু হয়, যেখানে তদন্তকারীরা বলেন, তিনি জিজ্ঞাসাবাদে ১,৭৭৮ বার "মনে নেই" বলেছেন।

 


এই মামলাগুলো ইসরাইলি সমাজকে তীব্রভাবে বিভক্ত করেছে। ২০২৩ সালে বিচার বিভাগ সংস্কার নিয়ে
দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। অনেকেই মনে করেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চলমান মামলার প্রেক্ষিতে তিনি
বিচারব্যবস্থাকে দুর্বল করার চেষ্টা করছিলেন।


হামাসের ৭ অক্টোবর ২০২৩–এর আক্রমণের পর গাজায় ইসরাইলি অভিযান, যা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংস
ডেকে আনে এবং মামলাগুলোর জনমত ও রাজনৈতিক গুরুত্ব ঢেকে দেয়। ইসরায়েলী সরকারের ডানপন্থী মিত্ররা
এখনো নেতানিয়াহুর প্রতি অনুগত। ৩০ নভেম্বরের এক জরিপে ৩৮% মানুষ তার পক্ষে ক্ষমার আবেদন
সমর্থন করেছে।
২০২৫ সালের নভেম্বরেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলের রাষ্ট্রপতি হারজগের কাছে নেতানিয়াহুকে ক্ষমা করার
অনুরোধ জানান। নিজের চিঠিতে তিনি লেখেন, “যদিও আমি ইসরাইলি বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা এবং তার
প্রয়োজনীয়তাকে সম্পূর্ণ সম্মান করি, আমি বিশ্বাস করি যে বিগত অনেক বছর ধরে আমার সঙ্গে লড়াই করা
এবং বিশেষ করে ইসরাইলের কঠিন প্রতিপক্ষ ইরানের বিরুদ্ধে লড়াই করা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে এই
‘মামলা’ একটি রাজনৈতিক এবং অনির্দিষ্ট প্রসিকিউশন।”


৩০ নভেম্বর নেতানিয়াহুর আইনজীবীরা ১১১ পৃষ্ঠার ক্ষমা আবেদন দাখিল করেন। প্রেসিডেন্টের দপ্তর
জানায়, এটি অত্যন্ত ব্যতিক্রমী আবেদন এবং গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হবে।

 

আগামী এক বছরের মধ্যে (২৭ অক্টোবর ২০২৬) জাতীয় নির্বাচন থাকায় নেতানিয়াহু চান মামলাগুলো দ্রুত
নিষ্পত্তি হোক। তবে দণ্ড ঘোষণার আগেই ক্ষমা পাওয়া ইসরাইলি আইনে নজিরবিহীন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী
এহুদ অলমার্টকেও দুর্নীতির অভিযোগে কারাদণ্ড হয়েছিল। তাই একই পরিস্থিতিতে নেতানিয়াহুর জন্য আলাদা
পথ তৈরি করা হলে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠবে।


বিরোধীদলীয় নেতা ইয়াইর লাপিদ স্পষ্টভাবে বলেছেন, নেতানিয়াহু অপরাধ স্বীকার, অনুতাপ প্রকাশ এবং
রাজনীতি থেকে সরে না গেলে ক্ষমা দেয়া উচিত নয়।


সাবেক বিচারমন্ত্রী হাইম রামোন আরও একধাপ এগিয়ে বলেন, “যদি সম্ভাবনা থাকে বলি- খুব ছোট, ক্ষমা
হবে না, শতাধিক লেখা আর কোটি কোটি প্রতিবেদন হলেও এটি সম্ভব নয়। নেতানিয়াহু রাজনীতি থেকে সরে না
গেলে এই গল্পের সমাধান হয় না।”