মঙ্গলবার   ১৮ নভেম্বর ২০২৫   অগ্রাহায়ণ ৪ ১৪৩২   ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

শেখ হাসিনার নির্দেশ ও গোপন বৈঠক-ট্রাইব্যুনালের রায়ে নতুন তথ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত : ০৩:৩৫ পিএম, ১৮ নভেম্বর ২০২৫ মঙ্গলবার

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের অবস্থান শনাক্ত করতে ড্রোন ব্যবহারের নির্দেশ দেন এবং তাঁদের দমন করতে হেলিকপ্টার ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন দেন—রায়ে এমনটাই উল্লেখ করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

 

গত বছরের ১৮ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে শেখ হাসিনার টেলিফোন আলাপ থেকেই এই আদেশের তথ্য প্রকাশ পায়। একইভাবে সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে তাঁর আরেকটি কথোপকথনও আদালতে উপস্থাপন করা হয়।

 

ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, ওই কথোপকথনসমূহ পেনড্রাইভ ও সিডিতে জমা দেওয়া হয়েছে এবং সিআইডির ফরেনসিক পরীক্ষায় সেগুলোকে সম্পূর্ণ আসল হিসেবে পাওয়া গেছে। এআই দিয়ে তৈরি বা পরিবর্তিত কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। আদালতে সেই অডিও শুনে ট্রাইব্যুনালের সদস্যরা এর সত্যতা নিশ্চিত হন।

 

এ মামলার মধ্য দিয়েই প্রথমবার গণ–অভ্যুত্থানকেন্দ্রিক মানবতাবিরোধী অপরাধের রায় ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল। চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড এবং সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন।

 

যৌথ পরিকল্পনা ও নৃশংসতার বর্ণনা

 

রায়ে বলা হয়, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দমনে তিনজনই পরস্পর যোগসাজশে কাজ করেছেন। চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনের সাক্ষ্যে উঠে আসে, স্বরাষ্ট্রসচিব থেকে শুরু করে বিভিন্ন গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থার প্রধানদের নিয়ে একটি মূল কমিটি (কোর কমিটি) গঠন করা হয়েছিল। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাইয়ের পর থেকে প্রতিরাতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় বৈঠক হত এবং সেখানেই শেখ হাসিনার পাঠানো নির্দেশনা অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হত।

 

মামুন জানান, আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে ড্রোন দিয়ে অবস্থান নির্ণয় এবং ‘লেথাল উইপেন’ বা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত আসে। শেখ হাসিনা নিজে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেন, যা পরবর্তীতে সারাদেশের পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল।

 

ট্রাইব্যুনাল বলেছে, এই নির্দেশনার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ছাত্রলীগ–যুবলীগের সদস্যেরা দেশজুড়ে হামলা চালায়। এর ফলে প্রায় ১,৫০০ মানুষের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে ঢাকার চানখাঁরপুলের ছয়জন এবং আশুলিয়ায় ছয়জন আন্দোলনকারী ছিলেন।

 

উসকানিমূলক বক্তব্য ও প্ররোচনা

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য মাকসুদ কামালের সাথে শেখ হাসিনার ১৪ জুলাইয়ের কথোপকথন আদালতে উপস্থাপন করা হয়। সেখানে শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ উল্লেখ করে বলেন-


“রাজাকারদের তো ফাঁসি দিয়েছি, এবার তোদেরও তাই করব। একটাও ছাড়ব না।”

 

ট্রাইব্যুনাল তার পর্যবেক্ষণে জানিয়েছে, এই বক্তব্য তাঁর দলীয় কর্মী ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে উত্তেজিত করে এবং আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় প্ররোচিত করে।

 

কোটা আন্দোলন অবমূল্যায়ন

 

রায়ে আরও বলা হয়, ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে শেখ হাসিনা তুচ্ছ–তাচ্ছিল্যপূর্ণ মন্তব্যে অবমূল্যায়ন করেন, যা শিক্ষার্থীদের ক্ষুব্ধ করে আরও বৃহত্তর আন্দোলনের দিকে ঠেলে দেয়।