জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে নানা প্রশ্ন
তরুণ কণ্ঠ রিপোর্ট
প্রকাশিত : ১২:৫৭ পিএম, ২৫ অক্টোবর ২০২৫ শনিবার
রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে প্রণীত ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ধারণে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনাকালে দেখা দিচ্ছে একের পর এক প্রশ্ন। এক প্রশ্নের সমাধান করলে দেখা দিচ্ছে নতুন প্রশ্ন। শেষ পর্যন্ত এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, সাংবিধানিক আদেশ জারি ও গণভোটের মাধ্যমে পাস হলেও আগামী সংসদে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন কিভাবে নিশ্চিত করা যাবে? এ নিয়ে আজ শনিবার ফের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠকে বসবে কমিশন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, জুলাই সনদ যখন প্রণয়ন করা হচ্ছিল, তখন এর বাস্তবায়ন বিষয়টি আলোচনায় আসেনি। সনদের খসড়া প্রণয়নের বিষয়টি আলোচনায় আসে। এমনকি নানা
প্রক্রিয়ায় সনদের ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো গেলেও সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। আইনি ভিত্তির প্রশ্নে গণভোটের সিদ্ধান্তে একমত হলেও গণভোটের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি দলগুলো।
এ অবস্থায় সনদের সঙ্গে পৃথক সুপারিশ আকারে সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি সংক্রান্ত প্রস্তাব সরকারকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানায় কমিশন। কমিশনের সিদ্ধান্ত মেনে সংস্কারপ্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া ৩০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৫টি দল স্বাক্ষর করলেও পাঁচটি দল এখনো স্বাক্ষর করেনি। এর মধ্যে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা ছাত্র-তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত স্বাক্ষর করবে না বলে জানিয়েছে। গত ১৭ অক্টোবর জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পর থেকে এ নিয়ে কাজ করছে কমিশন।
কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বিএনপিসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মতামত এড়িয়ে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির জন্য প্রথমে সাংবিধানিক আদেশ জারির প্রস্তাব করা হবে। জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি প্রস্তাবিত ওই আদেশের নাম হবে ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান সংস্কার) আদেশ-২০২৫’। এটি সংবিধান ও অন্যান্য আইনের পরিপূরক হবে। ‘গণ-অভ্যুত্থানের ক্ষমতাবলে বিশেষ পরিস্থিতিতে এ আদেশ জারি করা হবে।’ এরপর একটি অধ্যাদেশ করা হবে।
অধ্যাদেশের মাধ্যমে গণভোট হবে। এ ছাড়া বাস্তবায়ন সুপারিশে আগামী সংসদের দ্বৈত ভূমিকার প্রস্তাব করা হবে। একটি ভূমিকা হলো সংবিধানের দরকারি সংশোধনগুলো করা, অন্যটি হলো নিয়মিত সংসদ হিসেবে পরবর্তী নির্বাচনের আগপর্যন্ত কাজ চালিয়ে যাওয়া। সে ক্ষেত্রে আগামী সংসদ ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ হিসেবে ৯ মাসে বা ২৭০ দিনে জুলাই সনদ অনুযায়ী সংবিধান সংস্কার করবে।
বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংবিধান সংস্কার পরিষদ যদি ৯ মাসের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন না করে, তাহলে কী হবে? সে ক্ষেত্রে প্রস্তাব করা হয়েছে, ৯ মাসের মধ্যে সংস্কার না করলে সংসদ এবং পরিষদ বিলুপ্ত হবে। তখন জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজন হবে। সে ক্ষেত্রে পরবর্তী সংসদের সংস্কারের বাধ্যবাধকতা থাকবে কি-না? আবার গণভোটের মাধ্যমে যে পরিষদ গঠিত হবে, তা বিলুপ্ত করার এখতিয়ার গণভোট ছাড়া কারো থাকতে পারে না। সেই প্রশ্নের সমাধান কিভাবে মিলবে?
প্রশ্ন উঠেছে, সাংবিধানিক আদেশ জারি কে করবেন, রাষ্ট্রপতি না প্রধান উপদেষ্টা? এই আদেশ জারিতে আপত্তি রয়েছে বিএনপির। আর রাষ্ট্রপতির আদেশ চায় না জামায়াত ও এনসিপি। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো বলেছে, বিদ্যমান আইনের অধীনে প্রজ্ঞাপন জারি করে গণভোট ও সংসদ নির্বাচন একই দিনে হতে হবে। আর জামায়াত ও এনসিপি চায় সাংবিধানিক আদেশ জারির মাধ্যমে নির্বাচনের আগে গণভোট দিতে হবে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছে কমিশন।
বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে কমিশন একমত হয়েছে, একটি প্রশ্নে গণভোট হবে। গণভোটের প্রশ্নের বিষয়ে প্রস্তাবৃ করা হয়েছে, ‘আপনি কি আদেশ এবং সংস্কার সমর্থন করেন কিনা?’ ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ ভোটের মাধ্যমে জনগণ মতামত জানাবে। সে ক্ষেত্রে জুলাই সনদের বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’র বিষয়টি পৃথকভাবে থাকবে না গণভোটে। তাহলে বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল সংবিধান সংস্কারের যে ৯টি বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে, তার কী হবে? গণভোটে যদি ‘হ্যাঁ’ পাস হয় এবং বিএনপি সংসদ গঠন করে, তাহলে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়া প্রস্তাবগুলো কি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিবে বিএনপি?
বিদ্যমান অবস্থায় সংবিধান সংস্কারে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন হয়। সে ক্ষেত্রে জুলাই সনদের সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে সংবিধান সংস্কার পরিষদের সাধারণ নাকি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগবে? আগামী সংসদে কোনো দল দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে পরিস্থিতি কী হবে? তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। আবার আগামী সংসদে কোনো দল যদি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, অর্থাৎ যদি ঝুলন্ত সংসদ হয়, তখন কী হবে? আবার সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে কোনো দল সরকার গঠনে ব্যর্থ হলে যদি নতুন নির্বাচনের প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে সেই নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে? কারণ সংবিধান সংস্কার ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল হবে না। আবার সংসদ ভেঙে গেলে ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদের’ পরিণতি কী হবে?
এ অবস্থায় ঐকমত্য কমিশন চায় এমন কোনো বিধান করা, যা সনদ বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দেবে। ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ধারণে আমরা চূড়ান্ত পর্যায়ে আছি। আদেশের খসড়া প্রস্তাবে কী কী থাকবে, তা বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বাস্তবায়নে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ আসতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা ও সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। এ নিয়ে শনিবার আবারও বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে বসবে কমিশন। আজকালের মধ্যে সব কিছু চূড়ান্ত করে সরকারের কাছে সুপারিশ তুলে দেওয়া সম্ভব হবে বলে আশা করছি।’
