শাহজালালে বন্ধ ই-গেট সেবা, ইমিগ্রেশনে সেই আগের ভোগান্তি
মোঃ নুর জাহান আক্তার নূপুর
প্রকাশিত : ০১:০১ পিএম, ২০ অক্টোবর ২০২৫ সোমবার

ব্যাপক ঢাকঢোল পিটিয়ে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন কার্যক্রমে সহায়ক হিসেবে স্বয়ংক্রিয় বর্ডার কন্ট্রোল ব্যবস্থা (ই-গেট) কার্যক্রম সেবা চালু করে কর্তৃপক্ষ। এ গেট স্থাপনের তিন বছর পরও সুফল পাচ্ছেন না যাত্রীরা। আগের মতোই লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ইমিগ্রেশন কার্যক্রম সম্পন্ন করছেন তারা। পোহাতে হচ্ছে ভোগান্তি।
অথচ ই-গেট চালু হওয়ার আগে ও পরে এর সুবিধা নিয়ে ব্যাপক ঢাকঢোল পিটিয়েছিল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। বলা হয়েছিল, অল্প সময়ে কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই যাত্রী নিজে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে পারবেন। অর্থাৎ, ই-পাসপোর্ট নিয়ে যখন ই-পাসপোর্টধারী একজন ব্যক্তি ই-গেটের কাছে যাবেন, তখন একটি নির্দিষ্ট স্থানে ই-পাসপোর্টটি রাখলে সঙ্গে সঙ্গে গেট খুলে যাবে। নির্দিষ্ট নিয়মে গেটের নিচে দাঁড়ানোর পর ক্যামেরা ছবি তুলে নেবে। এরপর সব ঠিকঠাক থাকলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই যাত্রী ইমিগ্রেশন পেরিয়ে যেতে পারবেন।
যাত্রীদের অভিযোগ, এখন বিমানবন্দরের কোনো ই-গেট সচল নেই। যাত্রীরা এর সুফল পাচ্ছেন না। উল্টো ইমিগ্রেশনের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
শাহজালালে বন্ধ ই-গেট সেবা, ইমিগ্রেশনে সেই আগের ভোগান্তি
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ই-পাসপোর্ট চালু করে বাংলাদেশ। এর সুফল নিতে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চালু করা হয় ই-গেট। স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করায় দ্রুত সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল ইমিগ্রেশন কার্যক্রম। তবে কারিগরি ত্রুটি, যাত্রীর ভিসা যাচাইসহ অন্য কাজ ম্যানুয়ালি করায় জটিলতা সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ ই-গেট খোলা থাকলেও সেই আগের নিয়মেই যেতে হতো ইমিগ্রেশন ডেস্কে। এতে জটিলতা বাড়ায় ই-গেটের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে।
যদিও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইমিগ্রেশন পুলিশের একাধিক সদস্য জানান, দিনে যত সংখ্যক যাত্রী বিমানবন্দর ব্যবহার করছেন, তাদের প্রায় ৪০ শতাংশের ই-পাসপোর্ট রয়েছে। এ পাসপোর্ট দিয়ে ই-গেটে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শুধু পাসপোর্ট ও যাত্রীকে শনাক্ত করা যায়। কিন্তু স্বয়ংক্রিয়ভাবে যাত্রীর ভিসা পরীক্ষা করা যায় না। এছাড়া যাত্রী কোথায় যাবে, কোন উড়োজাহাজে ভ্রমণ করবে, ই-গেটে সেই তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। ফলে ই-গেট ব্যবহার করলেও আগের মতোই ভিসা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে ম্যানুয়ালি। এতে ইমিগ্রেশনে যাত্রীদের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হয়। এর মধ্যে কাছাকাছি সময়ে একাধিক ফ্লাইট অবতরণ করলে বা গেলে ইমিগ্রেশনে আরও বেশি চাপ পড়ে। এই চাপ সামলাতে ইমিগ্রেশন পুলিশকেও হিমশিম খেতে হয়।
শাহজালাল বিমানবন্দর সূত্র জানায়, ই-পাসপোর্ট চালুর পর ই-পাসপোর্ট ও অটোমেটেড বর্ডার কন্ট্রোল (এবিসি) ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের আওতায় ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরসহ দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দরে মোট ৫০টি ই-গেট স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছিল সরকার। এরই অংশ হিসেবে শাহজালাল বিমানবন্দরে ২০২২ সালের জুনে ২৬টি ই-গেট স্থাপন করে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট বিভাগ (ডিআইপি)। এর মধ্যে আগমনীতে ১২টি, বহির্গমনে ১২টি ও ভিআইপিতে দুটি ই-গেট রয়েছে। যাদের ই-পাসপোর্ট রয়েছে, তারা এসব গেট ব্যবহার করে দ্রুত ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করার কথা।
শাহজালালে বন্ধ ই-গেট সেবা, ইমিগ্রেশনে সেই আগের ভোগান্তি
ই-গেটের বিষয়টি আমাদের ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্টের। তাদের ই-গেট দিয়ে ইমিগ্রেশন করা সম্ভব। কিন্তু দেখা যায়, ই-গেটে ইমিগ্রেশন সম্পন্নের পরও ম্যানুয়ালি যেতে হয়। তখন এ গেটের ব্যবহার নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা শুরু হয়। এ কারণে আপাতত ই-গেটের কার্যক্রম বন্ধ।- শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এসএম রাগীব সামাদ
ই-গেট সাধারণত প্রথমে যাত্রীর পাসপোর্ট পরীক্ষা করে। পাসপোর্ট ঠিক থাকলে প্রথম ব্যারিয়ার খুলে যায়। এগিয়ে পরের গেটে গেলে সেখানে ক্যামেরায় পাসপোর্টধারীর মুখ ও চোখ স্ক্যান করা হয়। পাসপোর্টের ছবির সঙ্গে যাত্রীর চেহারা মিলে গেলে খুলে যাবে পরের ব্যারিয়ার। ছবি না মিললে বা পাসপোর্ট ভুয়া হলে কিংবা বিদেশ ভ্রমণে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ব্যারিয়ার খুলবে না। এমন ধারণা থেকে ই-গেট চালু করা হয়, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবহার হয়ে আসছে।
যদিও ই-গেট স্থাপনের পর ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরেজমিনে শাহজালাল বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পার হতে গিয়ে দেখা যায়, যাদের ই-পাসপোর্ট আছে, তাদের অনেকেই ই-গেট ব্যবহার করেননি। আবার যারা ব্যবহার করছিলেন, তাদের ভিসা যাচাইসহ অন্য কাজে ফের ইমিগ্রেশন ডেস্কে যেতে হয়েছিল। এতে বিরক্ত ছিলেন যাত্রীরা। কার্যত কোনো সুফলই মেলনি।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, বহির্গমনে সবকটি ই-গেট বন্ধ রয়েছে। কী কারণে তা বন্ধ তার কোনো নোটিশ নেই। ই-গেটগুলোর ওপর ধুলাবালির আবরণ পড়েছে। প্রতিটি ইমিগ্রেশন কাউন্টারে যাত্রীদের ভিড়। এই প্রতিবেদককে লাইনে দাঁড়িয়ে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে প্রায় ৪৫ মিনিট সময় লাগে। এর কারণ, প্রতিটি যাত্রীর ভিসা যাচাইসহ আনুষঙ্গিক কাজ করতে গড়ে পাঁচ মিনিট করে সময় নিচ্ছেন ইমিগ্রেশন পুলিশের সদস্যরা।
একইভাবে ১ অক্টোবর ভোরে আগমনের সময় দেখা যায়, ইমিগ্রেশনের সামনে হাজারো যাত্রীর ভিড়। কারণ, একই সঙ্গে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কুয়েত ও তুরস্ক থেকে কাছাকাছি সময়ে ওয়াইড বডির পাঁচটি উড়োজাহাজ শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এজন্য আট থেকে ১০টি লাইনে যাত্রীরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করেন। দীর্ঘ এ লাইনে দাঁড়িয়ে সবাইকে ক্লান্ত দেখা যায়। বিশেষ করে বয়স্ক ও শিশুদের ভোগান্তি ছিল বেশি।
ওইদিন ভোরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজে প্রায় তিন শতাধিক যাত্রী শাহজালাল বিমানবন্দরে নামেন। তাদের মধ্যে ছিলেন নোয়াখালীর আবু বকর। তড়িঘড়ি করে উড়োজাহাজ থেকে নেমে তিনি ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়ান। কিন্তু দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকায় তার চার বছরের ছেলেটাও কান্না করছিল।
শাহজালালে বন্ধ ই-গেট সেবা, ইমিগ্রেশনে সেই আগের ভোগান্তি
আবু বকর জানান, পরিবার নিয়ে মালয়েশিয়ায় ছুটিতে গেছিলেন তারা। সেখানে যাওয়া এবং আসার পথে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে সব মিলে ৮-১০ মিনিট সময় লেগেছে। তেমন বড় কোনো লাইনে দাঁড়াতে হয়নি। কিন্তু দেশের ভেতর লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত।
তিনি বলেন, আমাদের পরিবারের সবার ই-পাসপোর্ট রয়েছে। এখন ই-পাসপোর্ট থাকলেও ই-গেটের সেবা পাচ্ছি না। সবার সঙ্গে আগের মতোই লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে।’
দীর্ঘ সাত-আট ঘণ্টা জার্নি করে ইমিগ্রেশনে আবার লাইনে দাঁড়ানো খুব বেশি কষ্টের বলে জানান সৌদি প্রবাসী মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ই-গেটগুলো চালু থাকলে তাদের লাইনে লোকজন কম হতো। এখন সবাই একই লাইনে দাঁড়ান। ইমিগ্রেশন শেষ করতে দেরি হয়।’
জানতে চাইলে শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এসএম রাগীব সামাদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ই-গেটের বিষয়টি আমাদের ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্টের। তাদের ই-গেট দিয়ে ইমিগ্রেশন করা সম্ভব। কিন্তু দেখা যায়, ই-গেটে ইমিগ্রেশন সম্পন্নের পরও ম্যানুয়ালি যেতে হয়। তখন এ গেটের ব্যবহার নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা শুরু হয়। এ কারণে আপাতত ই-গেটের কার্যক্রম বন্ধ। আশাকরি সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে শিগগির এ সেবা চালু হবে।’