শুক্রবার   ১০ অক্টোবর ২০২৫   আশ্বিন ২৫ ১৪৩২   ১৭ রবিউস সানি ১৪৪৭

বিশ্বব্যাংকের সতর্কতা: দারিদ্র্য আবারও বাড়ছে

মোঃ মোসাদ্দেক হোসাইন ইমন, স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত : ০২:১৩ পিএম, ৮ অক্টোবর ২০২৫ বুধবার

বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার চলতি বছরে ২১ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছতে পারে-যা গত চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন “বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট”-এ বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের তুলনায় দারিদ্র্যের হার বেড়েছে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ।

 

প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গত এক বছরে দেশের শ্রমবাজারে বড় ধাক্কা লেগেছে। ২০২৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ৬০ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৫৮ দশমিক ৯ শতাংশে। অর্থাৎ প্রায় ৩০ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়েছেন, যার মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি-প্রায় ২৪ লাখ। কর্মসংস্থানের হারও কমে এসেছে ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশে।

 

বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ, ২০২৩ সালে বেড়ে হয় ১৯ দশমিক ২ এবং ২০২৪ সালে দাঁড়ায় ২০ দশমিক ৫ শতাংশে। তবে প্রতিবেদনে আশার বার্তাও আছে-যদি সরকার পরিকল্পিত অর্থনৈতিক সংস্কারগুলো বাস্তবায়নে সক্ষম হয়, ব্যাংক খাত পুনর্গঠিত হয় এবং বিনিয়োগ ও রেমিট্যান্স প্রবাহ টিকে থাকে, তাহলে ২০২৬ থেকে দারিদ্র্য হ্রাসের ধারা শুরু হতে পারে।

 

এর আগে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও পিপিআরসি জানিয়েছিল, দেশে দারিদ্র্য ক্রমেই বাড়ছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের শুরুতে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৯ দশমিক ২ শতাংশ। অন্যদিকে পিপিআরসির সাম্প্রতিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশের সামগ্রিক দারিদ্র্য ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, আর অতিদারিদ্র্য বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

 

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “দারিদ্র্যের পরিসংখ্যান কেবল কাগজে-কলমে বোঝা যায় না, বাস্তবেই তা চোখে পড়ে। রাস্তায়, গ্রামে কিংবা শহরে মানুষের জীবনযাত্রা এখন আগের চেয়ে কষ্টকর।” তিনি নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের উক্তি তুলে ধরে বলেন, “দরিদ্র মানুষকে চেনার জন্য পরিমাপের দরকার নেই; তাদের মুখেই জীবনের কষ্টের ছাপ।”

 

বিশ্বব্যাংকের মতে, চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও প্রকৃত মজুরি হ্রাস দারিদ্র্য বৃদ্ধির বড় কারণ। ২০২৫ অর্থবছরে স্বল্প আয়ের শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি ২ শতাংশ কমেছে। তবে ২০২৬ সালে দারিদ্র্যের হার ১৯ দশমিক ১ এবং ২০২৭ সালে তা নেমে ১৮ দশমিক ১ শতাংশে আসতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।

 

প্রতিবেদনে বলা হয়, যদি নীতিগত সংস্কার ও আর্থিক পদক্ষেপ সময়মতো বাস্তবায়ন করা যায়, তবে আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে যাবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এলে এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়লে দেশের বেসরকারি ভোগব্যয় ও বিনিয়োগ আরও বিস্তৃত হবে।

 

তবে সংস্থাটি সতর্ক করে বলেছে, এ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া অত্যন্ত নাজুক। এর সফলতা নির্ভর করবে তিনটি বিষয়ের ওপর—সংস্কারের বাস্তবায়ন, ব্যাংক খাতের পুনর্গঠন, এবং অভ্যন্তরীণ-বৈদেশিক অর্থনৈতিক পরিবেশের স্থিতিশীলতা।

 

বিশ্বব্যাংক চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৮ শতাংশ হবে বলে অনুমান করেছে। বিনিয়োগ বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরলে দারিদ্র্য হ্রাস পেতে পারে।

 

অর্থনীতিবিদদের মতে, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ঘাটতি দারিদ্র্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, “যখন বিনিয়োগ থেমে যায়, কর্মসংস্থানও থেমে যায়। দাম বাড়ে, আয় কমে, মানুষ টিকে থাকতে হিমশিম খায়। ফলে দারিদ্র্য বেড়ে যায়।”

 

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহসভাপতি ড. সাদিক আহমেদ বলেন, “দেশে শিক্ষিত তরুণদের বেকারত্ব উদ্বেগজনক। কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধিকে এখন অর্থনৈতিক সংস্কারের কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে হবে।”

 

বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. ফ্রানজিস্কা ওনসর্জ বলেন, “বাংলাদেশের জন্য উন্মুক্ত বাণিজ্য ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহারের সুযোগ বিশাল। সঠিক সংস্কার ও প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও উৎপাদনশীলতা উভয়ই বাড়ানো সম্ভব।”