শুক্রবার   ০৩ অক্টোবর ২০২৫   আশ্বিন ১৭ ১৪৩২   ১০ রবিউস সানি ১৪৪৭

ফের লন্ডন সফরে ট্রেসি, তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের সম্ভাবনা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশিত : ১১:৪১ এএম, ২ অক্টোবর ২০২৫ বৃহস্পতিবার

জাতীয় নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের নানামুখী টানাপোড়েনের মধ্যে আবারও লন্ডন সফরে গেলেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত (চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স-সিডিএ) ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন। বুধবার (০১ অক্টোবর) সকালে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে তিনি ঢাকা ছেড়েছেন। বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র কালবেলাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ট্রেসির সফরসঙ্গী হিসেবে রয়েছেন তার স্বামী ডেভিড বাফ। তার পরও এই সফরকে নিছক ব্যক্তিগত সফর বলে মানতে নারাজ অনেকে। বরং তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ট্রেসির দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাজ্যের লন্ডন সফর নিয়ে নানামুখী গুঞ্জন ভাসছে ঢাকার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অঙ্গনে।নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র বলছে, ট্রেসির যুক্তরাজ্য সফরের নেপথ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। এই সফরে তার সঙ্গে লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক হতে পারে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও এ বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

 

এর আগে গত জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে লন্ডন সফরে গিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে প্রথম দফায় বৈঠক করেন ট্রেসি। ওই বৈঠকে বাংলাদেশের ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন এবং সরকার গঠন নিয়ে বিএনপির ভাবনা ও পরিকল্পনা নিয়ে দুজনের মধ্যে আলোচনা হয় বলে সে সময় গণমাধ্যমকে জানান তারেক রহমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবীর। এ ছাড়া নির্বাচনে জয়ী হলে বিএনপি কেমন দেশ গড়তে চায় এবং নির্বাচন কমিশন ঘোষিত রূপরেখা নিয়ে তাদের মতামত কী—এমন মৌলিক নানা বিষয়ও উঠে আসে তারেক ও ট্রেসির ওই আলোচনায়।

 

এর আগে নির্বাচন ও দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে লন্ডনে গিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। মূলত ওই বৈঠকের পরই আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে সুস্পষ্ট ঘোষণা আসে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে।

এমন প্রেক্ষাপটে তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ট্রেসি জ্যাকবসনের পুনরায় লন্ডনযাত্রা নিয়ে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। তার এবারের সফর যুক্তরাষ্ট্রের ‘ট্র্যাক টু ডিপ্লোমেসির’ অংশ হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

 

যেভাবে লন্ডন গেলেন ট্রেসি : শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দায়িত্বশীল একটি সূত্র গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ও তার স্বামীর পাসপোর্ট নম্বর, যা বিমানবন্দরের ডিজিটাল নথিতে রেকর্ড রয়েছে, তা পর্যবেক্ষণ করে তাদের দুজনের ঢাকা ত্যাগের বিষয়টি কালবেলাকে নিশ্চিত করে।

রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন এবং তার স্বামী ডেভিড বাফ এদিন সকাল ১১টা ৫ মিনিটে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ইকে-৫৮৩-এ যাত্রা করেন। ফ্লাইটটির দুবাইয়ে যাত্রাবিরতি দিয়ে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হওয়ার শিডিউল নির্ধারিত ছিল। যে যাত্রা সাধারণত ১২-১৪ ঘণ্টার। জানা গেছে, ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন সপ্তাহখানেক যুক্তরাজ্যে অবস্থান করবেন।

 

তবে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের এক কর্মকর্তার দাবি, এটি একটি নির্ধারিত সফর, সিডিএ ছুটিতে আছেন। তারেক রহমানের সঙ্গে এবারের সফরেও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের ফের বৈঠক হবে কি না—এ বিষয়ে অবগত নন জানিয়ে ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এর আগেও সিডিএ যে তারেক রহমানের সঙ্গে নিজে গিয়ে বৈঠক করেছেন, তা দূতাবাসের অল্প কয়েকজন ছাড়া কেউ-ই জানেন না। আসলে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তারা গোপনীয় রাখতে চান।’

 

ট্রেসির সফরের গোপনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন : নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের এবারের সফরে তারেক রহমানের সঙ্গে লন্ডনের একটি নিরাপদ স্থানে বৈঠক হবে। যাতে আলোচনায় থাকবে নির্বাচনী রোডম্যাপ, বিরোধী দলের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের ভূমিকা এবং নির্বাচন নিয়ে শেষ সময়ে দলের পক্ষ থেকে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তা। এ ছাড়া ভোটে জিতে ক্ষমতায় এলে বিএনপি দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারবে কি না—তা নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে আলোচনা হতে পারে।

 

এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এক সাবেক কূটনীতিক কালবেলাকে বলেন, ‘জুলাইয়ের বৈঠক ছিল প্রাথমিক, এবার যদি বৈঠক হয়, তা হবে আরও গভীর। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচনকে দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার সঙ্গে যুক্ত করে দেখছে। তারেক রহমানের সঙ্গে এই সংলাপ বিএনপির আন্তর্জাতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করবে।’

তবে গত জুলাইয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে ট্রেসির বৈঠক নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো কিছুটা অস্বস্তিতে ছিল। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের এমন তৎপরতা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল। এ ছাড়া বরাবরই নির্বাচন এলে তাদের হস্তক্ষেপ বেড়ে যায়।

 

জুলাই বৈঠকের পর যা ঘটেছিল : ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের এবারের সফরের আলোচনাকে আরও গভীরতা দিচ্ছে—গত ১২ জুলাই লন্ডনে হওয়া জ্যাকবসন ও তারেক রহমানের মধ্যকার একান্ত বৈঠক। যদিও ওই বৈঠকটিও ছিল অআনুষ্ঠানিক, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে এর বিবরণ প্রকাশিত হয়। ওই বৈঠকে উভয়পক্ষ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি, বিরোধী দলের অংশগ্রহণের সুযোগ এবং মানবাধিকার সংক্রান্তসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা করে। বিএনপির পক্ষ থেকে সেই বৈঠককে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের দলের সম্পর্ক জোরদারের একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়।

 

এ প্রসঙ্গে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, জুলাইয়ে লন্ডনের বৈঠকের পর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারের উপর নির্বাচনী সংস্কারের চাপ বেড়েছে। এমনকি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একটি বিবৃতিতেও বলা হয়েছে, যে দেশটি একটি অংশগ্রহণমূলক এবং স্বচ্ছ নির্বাচনের পক্ষে। এ ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক নিয়ে বরাবরই তাদের দাবি যে, তাদের নীতি—তারা সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যায়।’

 

যুক্তরাষ্ট্রের ট্র্যাক টু ডিপ্লোমেসি কী : অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে রাজনৈতিক বার্তা আদান-প্রদান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে আগাগোড়াই। যদিও ট্রেসির এবারের সফরে সঙ্গে তার স্বামী থাকায় সফরটি ব্যক্তিগত বলে দাবি করা হলেও এটি মানছেন না বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এটি যুক্তরাষ্ট্রের ট্র্যাক টু ডিপ্লোমেসি, যা অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে রাজনৈতিক বার্তা আদান-প্রদানের একটি কৌশল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন সময়ে এটি প্রয়োগ করেছে দেশটি, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং নির্বাচনী সংস্কারের লক্ষ্যে।

 

\এ নীতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র সরকারি নয় এমন ব্যক্তি, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক বা অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমে বিরোধী দল এবং সরকারের মধ্যে সংলাপ সহজতর করে, যাতে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং মানবাধিকার নিশ্চিত হয়। বাংলাদেশে এর উদাহরণ গত জুলাইয়েও দেখা যায়, যখন যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন। যা অনানুষ্ঠানিক সৌজন্য বৈঠক হিসেবে অনুষ্ঠিত হয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনার তথ্য প্রকাশিত হয় না; কিন্তু এর মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নির্বাচন এবং বিরোধী দলের অবস্থান নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়।

 

যা আপাতদৃষ্টিতে ব্যক্তিগত বলে দাবি করা হলেও রাষ্ট্রদূতের পদমর্যাদা এবং এর রাজনৈতিক তাৎপর্য এটিকে ট্র্যাক টু ডিপ্লোমেসির আওতায় নিয়ে আসে। দক্ষিণ এশিয়ায় ট্র্যাক টু ডিপ্লোমেসির ব্যাপক ব্যবহার—যেমন ভারত-পাকিস্তান সংলাপে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলেছিল।

নির্বাচনপূর্ব কূটনৈতিক ঝড়, বাড়ছে আন্তর্জাতিক চাপ : বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নির্ধারিত করেছে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে, সে অনুযায়ী নির্বাচনের বাকি আর মাত্র ৫ মাস, তাই দেশে নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পর্যবেক্ষণ বেড়েছে। এরই মধ্যে ইউরোপীয়

ইউনিয়নের প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদল বাংলাদেশ সফর করে গিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক নীতিতে সরকার ও বিরোধী দলের সঙ্গে সমান দূরত্ব বজায় রাখা একটি মূলনীতি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কূটনীতিক কালবেলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো দেশে নির্বাচনপূর্ব সংলাপ গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও দরকারি। যেহেতু এ মুহূর্তে তারেক রহমান দেশে নেই, ফলে তার সঙ্গে বৈঠক করতে লন্ডন যাওয়া ছাড়া উপায়ও নেই। আর তারা জামায়াতসহ অন্যান্য দলের সঙ্গেও সংলাপে বসছে। নির্বাচনের আগে তারা সব পক্ষেরই বক্তব্য শোনে।’

 

যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক এক রাষ্ট্রদূত কালবেলাকে বলেন, ‘এ সফরের ফল কী হবে, তা লন্ডন থেকে স্পষ্ট হবে। তবে এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে।’

 

তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের লন্ডন সফর আপাতত একটি কূটনৈতিক যাত্রা বলে মনে হলেও, তারেক রহমানের সঙ্গে নতুন বৈঠকের নিশ্চয়তা এটিকে রাজনৈতিক ঘটনায় পরিণত করেছে। জুলাইয়ের বৈঠকের ধারাবাহিকতায় এই সংলাপ নির্বাচনপূর্ব পরিবেশকে আরও উত্তপ্ত করবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখ রাখা রয়েছে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রায় এবং এ সফর তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।’