মানবিক ডাক্তার বাসুদেব কুমার সাহা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত : ০৪:৫৬ পিএম, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ সোমবার

ডা. বাসুদেব কুমার সাহা। রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে নাক, কান ও গলা বিভাগে সিনিয়র কনসালটেন্ট এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ম্যালিয়াস ইএনটি স্পেশালাইজড হাসপাতালে চীফ কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন রোগীর চিকিৎসা করেছেন ডা. বাসুদেব কুমার সাহা। পাশাপাশি যেসব রোগীর চিকিৎসা বিদেশের মাটিতে হয়নি, তাদেরও চিকিৎসা করিয়ে দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। সম্প্রতি ৬৫ বছর বয়সী কুমিল্লার বাসিন্দা জনাব আবুল কাশেম এর গলার সামনে বিশাল বড় এক থাইরয়েড টিউমার এর সফল সার্জারী তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
তথ্য বলছে, টানা ৪৫ বছর ধরে গলায় থাইরয়েড টিউমার নিয়ে বসবাস করেছেন ৬৫ বছর বয়সী আবুল কাশেম। সাত সন্তানের এই জনক দেশ ও দেশের বাইরে গিয়েও এই টিউমারের সঠিক কোনো সমাধান পাননি। অপারেশনে মৃত্যু ঝুঁকি থাকার কারণে বার বার পিছপা হয়েছেন তিনি। তাইতো অসহ্য যন্ত্রণা নিয়েই ধুঁকে ধুঁকে ৪৫ বছর অতিবাহিত করেছেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস সময়ের সাথে সাথে টিউমারটি ফুলে ফেঁপে এমন অবস্থায় চলে গিয়েছিল যে টিউমারের অতিরিক্ত ভরে মেরুদন্ড বাঁকা হয়ে গিয়েছিল। শ্বাশনালী ও খাদ্যনালীর ওপর চাপ তৈরি করেছিল বলে খাবার ঠিকমত খেতে পারছিলো না। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছিলো। বাঁচার আশা অনেকটা ছেড়েই দিয়েছিলেন তিনি। জীবন মৃত্যুর এই সন্ধিক্ষণে অনেকটা বাজপাখির মতো উড়ে এসে আবুল কাশেম ও তার পরিবারকে এক নতুন স্বপ্ন দেখান বাংলাদেশের তরুণ প্রতিভাবান ইএনটি স্পেশালিষ্ট ডা. বাসুদেব কুমার সাহা। কয়েক দফায় রোগীটিকে দেখে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেন টিউমারটির অপারেশন করার। অবশেষে চলতি মাসের ১ তারিখে ডা. বাসুদেব তার ১০ সদস্যের একটি টিম নিয়ে টানা ১০ ঘণ্টা আবুল কাশেমের অপারেশন পরিচালনা করে মরণব্যাধি থাইরয়েড টিউমারটি সফলভাবে গলা থেকে আলাদা করেন।
এদিকে বাবাকে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকিয়ে দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা যখন মৃত্যু ভয় আর শঙ্কায় উদ্বিগ্ন সন্তান আর স্বজনরা, ঠিক তখন অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে ডা. বাসুদেব নিজ মুখে জানালেন অপারেশন সাকসেসফুল, আব্বাজান জ্ঞান ফিরে পেয়েছেন, চোখ মেলে তাকিয়েছেন। ডাক্তারের এই কথা শোনার পর আল্লাহ বলে চিৎকার করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন রোগীর ছেলে মেয়েরা। আনন্দে চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন তারা। মাত্র তিন মাস আগে নিজের বাবাকে হারানো ডা. বাসুদেব রোগীর ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বাবা বাবা বলে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। মুহূর্তেই সৃষ্টি হয় এক মায়াময় পৃথিবী। যেখানে ফুটে ওঠে পিতার প্রতি সন্তানের এক অদৃশ্য ভালবাসা আর একজন মানবিক চিকিৎসকের অদেখা অনুভূতি আর রোগীর প্রতি উজার করা অকৃত্রিম ভালবাসা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গলার সামনে এত বড় থাইরয়েড গ্লান্ডের সার্জারী পৃথিবীতে খুবই বিরল। আর সেই বিরল কাজটিই করে বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন বাংলাদেশের চিকিৎসক ডা. বাসুদেব কুমার সাহা ও তার টিম। দীর্ঘ ১০ ঘন্টা ধরে চলা অপারেশনে এনেস্থিসিয়া পরিচালনা করেন ডা. এসএমএ আলীম।
অপারেশনের বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. বাসুদেব বলেন, ‘অপারেশনটি ছিল ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে থাকা টিউমার তার আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ নার্ভ, রক্তনালী, শ্বাসনালী, খাদ্যনালী, মাংশপেশীকে কঠিনভাবে আক্রমণ করেছিল। অনেকটা অক্টোপাসের মত জড়িয়ে রাখার মতো। এমন অবস্থায় এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রাকচার থেকে টিউমারকে আলাদা করা ছিল কঠিন চ্যালেঞ্জের। যেখানে একটু ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটলেই সব কিছু ম্যাচাকার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, নার্ভকাটা পড়ার সম্ভাবনা, তীব্র শ্বাসকষ্ট, অজ্ঞান থেকে জ্ঞান না ফেরাসহ রোগীর করুণ পরিণতির সমূহ সম্ভাবনা। এতগুলো চাপ মাথায় নিয়ে অপারেশন করাটা একটা যুদ্ধ জয়ের মত অবস্থা ছিল। অবশেষে টিউমার অপসারণ করে যুদ্ধে জয়ী হই আমরা। আর এটি সম্ভব হয়েছে সৃষ্টিকর্তার অসীম কৃপা মানুষের দোয়া আর আমার পুরো টিমের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং দক্ষতার জন্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি আমার টিমের প্রধান এনেস্থেটিস্ট ডা. আলীম ভাই, ইএনটি সার্জন ডা. নোবেল, ডা. আশিক, ডা. মামুন, ডা. সাব্বির, ডা. সোহান, ডা. আরাফাতসহ সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। কৃতজ্ঞতা মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে যে তিনি আমার মাধ্যমে এত জটিল একটি অপারেশন সফল করিয়েছেন।’
অপারেশন শেষে তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় অশ্রুশিক্ত চোখে আবুল কাশেমের মেয়ে সালমা বলেন ‘জন্মের পর বাবাকে কোনোদিন স্বাভাবিক চেহারায় দেখিনি। আমার সেই ইচ্ছাটা পূর্ণ হয়েছে।’
শুধু আবুল কাশেম নয়, তার মতো দেশ এবং বিদেশের বিভিন্ন রোগীকে মরণব্যাধি রোগ থেকে মুক্তি দিয়েছেন তিনি। দিয়েছেন নতুন করে জীবনকে উপভোগ করার সময়। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অধিকাংশ রোগীর অপারেশন করেন তিনি। পাশাপাশি গ্রামের অসহায় ও দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিচ্ছেন তিনি। তরুণ এই চিকিৎসকের দেশের পাশাপাশি বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক সুনাম রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তরুণ এই চিকিৎসকের স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক ভিডিও দেখে দেশের মানুষ সচেতন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তার কাছে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর স্বজনরা। তাদেরই একজন মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম।
মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডা. বাসুদেবের অনেক স্বাস্থ্য টিপস দেখি আমরা। তিনি খুব সুন্দর করে স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হওয়ায় বিভিন্ন মাধ্যম ও খাবারের তালিকা বলে দেন। এছাড়াও তার কাছে আসা অনেক রোগী মরণব্যাধি রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তার প্রতি আমাদের অগাধ বিশ্বাস রয়েছে, তার কাছে গেলে আমাদের আত্মীয় স্বজনরা সুস্থ্য হয়ে উঠবেন; এই আশায় তার কাছে চিকিৎসা নিতে আসি আমরা।’
কামরুল নামের আরেক রোগী বলেন, ‘আমার গলার সমস্যা ছিলো। অনেক জায়গায় চিকিৎসা করিয়ে ভালো হয়নি। শেষমেষ কোনো কিছু না ভেবে ডা. বাসুদেবের কাছে ছুটে আসি। তিনি রোগীদের খুব সহজে সুস্থ্য করে তুলতে পারে, এমন কথা শুনেছি। তবে সত্যিকার অর্থেই তিনি ভালো মানুষ। অনেক আন্তরিকভাবে রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফরিদপুর জেলার সালথা উপজেলার ফুলবাড়িয়া গ্রামে একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ডা. বাসুদেব। পরিবারের দারিদ্রতাকে পিছু হটিয়ে নিজের প্রচেস্টায় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ থেকে ২০০৮ সালে এমবিবিএস পাশ করেন। বহুমুখী প্রতিভাবান এই চিকিৎসক শুরু থেকেই রেখেছেন তার মেধার স্বাক্ষর। ফুলবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৩ সালে এবং ১৯৯৬ সালে ফুলবাড়িয়া উচ্চবিদ্যালয়, সালথা, ফরিদপুর থেকে যথাক্রমে প্রাইমারি ও ট্যালেন্টপুলে জুনিয়র স্কলারশিপ (বৃত্তি) লাভ করেন। ১৯৯৯ সালে ফুলবাড়িয়া উচ্চবিদ্যালয়, সালথা, ফরিদপুর এবং ২০০১ সালে নটরডেম কলেজ থেকে স্টার মার্কস নিয়ে যথাক্রমে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। ২০১১ সাথে বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের চিকিৎসক হিসেবে তিনি সরকারি চাকুরিতে যোগদান করেন। ২০১৩ সালে নাক কান গলা বিষয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী এমএস ভর্তি পরীক্ষায় সারা বাংলাদেশে ১ম স্থান অর্জন করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ২০২০ সালে তিনি তৎকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ইএনটিতে মেডিকেল সাইন্সের সর্বোচ্চ এম.এস ডিগ্রি সাফল্যের সাথে অর্জন করেন। পরবর্তীতে ইন্ডিয়া, নেপাল, থাইল্যান্ড থেকে নাক, কান, গল,া বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। নাক কান গলা বিষয়ে তার বেশ কয়েকটি গবেষণা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। সরকারি চাকুরির সুবাদে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটে সুনামের সাথে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন।