শুক্রবার   ০৩ অক্টোবর ২০২৫   আশ্বিন ১৭ ১৪৩২   ১০ রবিউস সানি ১৪৪৭

‘সাবা’ আমাকে সাহসী হতে শিখিয়েছে: মেহজাবীন

বিনোদন ডেস্ক

প্রকাশিত : ০৪:৩৮ পিএম, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ বৃহস্পতিবার

এক সময় চারপাশের সবাই একরাশ প্রশ্ন করত মেহজাবীন চৌধুরীকে ‘সিনেমা কবে করছ?’ টিভি নাটক, ওয়েব সিরিজ এবং অন্যান্য মিডিয়ায় অসংখ্য সফলতা থাকা সত্ত্বেও তিনি হাসি দিয়ে প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যেতেন। কখনও মুখে কিছু না বললেও মনে মনে তিনি জানতেন যে দিনটি আসবেই। তবে তিনি চাইতেন সেটি হোক এমন গল্পের সঙ্গে, যেখানে নিজেকে খুঁজে পাবেন, যা অভিনয় দক্ষতার পাশাপাশি তাঁর জীবনেরও এক নতুন অধ্যায় তৈরি করবে। সেই গল্পই এলো ‘সাবা’র মাধ্যমে।

 

 

সিনেমার মূল কাহিনি ঘুরপাক খায় এক তরুণীর জীবনসংগ্রামের চারপাশে। মেয়েটি বাবা হারানোর শোক সামলে অসুস্থ মাকে নিয়ে প্রতিদিনের লড়াই চালাচ্ছে। ৯০ মিনিটের এই চলচ্চিত্রের গল্প ও চিত্রনাট্য যৌথভাবে রচনা করেছেন মাকসুদ হোসেন ও ত্রিলোরা খান। ত্রিলোরা খান নিজেই তাঁর মা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন চরিত্রের রূপায়ণে। সেই ‘সাবা’র চরিত্রে প্রাণ দিয়েছেন মেহজাবীন চৌধুরী। 

 

চিত্রনাট্য হাতে পেয়ে পড়তে পড়তেই মেহজাবীনের ভেতরটা কেঁপে উঠেছিল। বাবা হারানো এক মেয়ের গল্প, অসুস্থ মাকে নিয়ে টিকে থাকার সংগ্রাম। এত সহজ অথচ এত গভীর। মেহজাবীনের ভাষায়, ‘আমি চরিত্রটা পড়েই বুঝেছিলাম, এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আমাকে এটি করতেই হবে।’

 

 

সেই মুহূর্ত থেকেই শুরু হয় তাঁর ভেতরের বদলে যাওয়ার এক যাত্রা। অসংখ্য রিহার্সাল, দিনরাতের প্রস্তুতি। ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর আগেই যেন তিনি হয়ে উঠেছিলেন নতুন একজন মানুষ। মেহজাবীন স্বীকার করেন, ‘আমি আসলে ততটা সাহসী নই। সাবা আমাকে সাহসী হতে শিখিয়েছে। প্রতিটি দৃশ্যে মায়ের জন্য লড়াই করা মেয়ের অনুভূতি আমাকে ভেতর থেকে বদলে দিয়েছে।’

 

 

গত রোববার যখন ‘সাবা’র ট্রেলার প্রকাশ পেল, সোশ্যাল মিডিয়ায় এক বিশাল আলোড়ন সৃষ্টি হলো। দেড় মিনিটের ছোট্ট ট্রেলারে প্রথমে দেখা যায় মা-মেয়ের খুনসুটি, তারপর ধীরে ধীরে সামনে আসে হাহাকার ও বেদনার গল্প। অসুস্থ মাকে নিয়ে মেয়ের টিকে থাকার লড়াই এখানে এত বাস্তবভাবে ফুটে উঠেছে যে, দর্শক মুহূর্তেই সংবেদনশীল হয়ে উঠেছেন। স্বল্প সময়ের মধ্যে পরিচালক দর্শককে বুঝিয়ে দিয়েছেন ছবির আবেগী গভীরতা। অভিনয়ে ছিলেন স্বচ্ছন্দ মেহজাবীন। তাঁর চেহারার ভঙ্গিমা, চোখের অভিব্যক্তি কখনও আনন্দ, কখনও বেদনা–সবকিছু জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে দর্শকের চোখে।

ট্রেলার দেখেই অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, ‘২২ বছর আগে মাকে হারানোর স্মৃতি ফিরে এলো।’ অন্য কেউ লিখেছেন, ‘এই সিনেমাটা মায়ের হাত ধরে হলে গিয়ে দেখব।’ সত্যিই, ‘সাবা’ শুধুই একটি সিনেমা নয়; এটি মা-সন্তানের আবেগের আদান-প্রদানের গল্প। মেহজাবীন নিজেও দর্শকদের আহ্বান জানিয়েছেন, যদি সম্ভব হয়, ছবিটি মায়ের হাত ধরে হলে গিয়ে দেখুন। সিনেমায় মায়ের চরিত্রে আছেন রোকেয়া প্রাচী। অঙ্কুর চরিত্রে রয়েছেন মোস্তফা মনোয়ার। তাদের সঙ্গে মেহজাবীনের প্রথমবারের কাজও যেন নতুন মাত্রা যোগ করেছে। 

পরিচালক মাকসুদ হোসেন দুই দশক ধরে স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা এবং বিজ্ঞাপনচিত্র তৈরি করেছেন, কিন্তু ‘সাবা’ তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনি। তাঁর জন্য এটি এক স্বপ্নের মতো যাত্রা। মেহজাবীনের জন্য ছিল চ্যালেঞ্জের। ‘পুরো টিমটাই নতুন। পরিচালকেরও এটি প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি। তবু সিনেমাটি করার পর আমি বুঝেছি, এত অপেক্ষার পরও বাছাইতে আমরা কোনো ভুল করিনি।’

‘সাবা’র আন্তর্জাতিক যাত্রা শুরু হয় ২০২৪ সালে, টরন্টো চলচ্চিত্র উৎসব থেকে। এরপর বুসান, রেড সি, গোথেনবার্গ, ওসাকা, ডালাস– একের পর এক আন্তর্জাতিক উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে ছবিটি। বেঙ্গালুরু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এশিয়ান সিনেমা প্রতিযোগিতা বিভাগে তৃতীয় পুরস্কার জিতে নেয় ‘সাবা’। মেহজাবীনের জন্য এই অভিজ্ঞতা ছিল বিস্ময়কর। ভাষা ভিন্ন, সংস্কৃতি ভিন্ন–তবু হাসির দৃশ্যে দর্শক হেসেছে, কান্নার দৃশ্যে নীরব থেকেছে, কেউবা অশ্রু ফেলেছে।

 

 

মেহজাবীন বলেন, ‘শো শেষে অনেক দর্শককে কাঁদতে দেখেছি। আগে ভাবতাম, আমরা বাঙালিরাই বেশি আবেগপ্রবণ। সেখানে দাঁড়িয়ে বুঝলাম, পৃথিবীর সব মানুষের আবেগ-অনুভূতি একই। গল্প, চরিত্র–সবকিছুই তাদেরও ভাবায়, কাঁদায়।’ তিনি আরও বলেন, একজন অভিনেত্রী চান পর্দার চরিত্র যেন দর্শককে টানে, আঁকড়ে ধরতে পারে। এ ধরনের চরিত্রে আমি আগে কখনও অভিনয় করিনি। তাই ‘সাবা’ আমার কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা।

পরিচালক মাকসুদ হোসেনের কাছে ‘সাবা’ নিছক একটি চলচ্চিত্র নয়; বরং এক আবেগের যাত্রা। টরন্টো থেকে শুরু করে এত উৎসবে প্রদর্শিত হলেও তাঁর মন সবসময় দেশের দর্শকের কাছে। অবশেষে পূজা উপলক্ষে মুক্তি পাচ্ছে ছবিটি। আজ যখন বাংলাদেশের সিনেমা নিয়ে এত আলোচনা, এত প্রত্যাশা–মেহজাবীন মনে করেন, সময়টা এখনই। তাঁর বিশ্বাস, বাংলাদেশের গল্প কেবল আমাদেরই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সমান প্রাসঙ্গিক। দেশের সিনেমা নিয়ে আশাবাদী মেহজাবীন মনে করেন, সময় এসেছে বিকাশের, নতুন প্রতিভাদের সুযোগ দেওয়ার।

তাঁর বিশ্বাস, ‘বাংলাদেশের গল্প আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রাসঙ্গিক। এটা কেবল শুরু। এবারও বাংলাদেশ কান চলচ্চিত্র উৎসবে জায়গা করে নিয়েছে, খুব শিগগিরই আমাদের প্রতিভার ছাপ ছড়িয়ে পড়বে সারা বিশ্বে। এজন্য ইন্ডাস্ট্রির ভেতরে আরও সহযোগিতা জরুরি, যাতে সম্মিলিতভাবে সিনেমাকে এগিয়ে নেওয়া যায়।’

মেহজাবীনের কাছে ‘সাবা’ কেবল সিনেমা নয়, এটি এক অভিজ্ঞতা, এক যাত্রা, এক অধ্যায় যা ভেতর থেকে ছুঁয়ে গেছে তাঁর আত্মা। আর দর্শকের জন্য? এটি মা-সন্তানের সেই চিরন্তন বন্ধন, যা পর্দায় ফুটে উঠেছে জীবন্ত হয়ে, হৃদয় ছুঁয়ে।