ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক উন্নীত হচ্ছে ১০ লেনে
তরুণ কণ্ঠ রিপোর্ট
প্রকাশিত : ০৫:৫৫ পিএম, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ শনিবার

দেশের অর্থনীতির ‘লাইফলাইন’ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক প্রশস্ত হচ্ছে, সমীক্ষা শেষ হয়েছে। সরকার মহাসড়কটি বর্তমান চার লেন থেকে ১০ লেনে উন্নীত করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। এতে ব্যয় হবে প্রায় ৬২ হাজার কোটি টাকা। বিশাল এই ব্যয় মেটাতে সরকারি- বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) ও বহুজাতিক সংস্থার তহবিল ব্যবহারের কথা বিবেচনা করছে সরকার।
সওজ সূত্রে জানা গেছে, এ প্রকল্পের উন্নয়ন প্রস্তাব চূড়ান্ত করতে আরও অন্তত ছয় মাস সময় লাগবে। ২০১৯ সালে এ মহাসড়কে দৈনিক গাড়ি চলাচলের সংখ্যা ছিল ৩৫ হাজার ৪৮২, যা ২০২৪ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার ৫০১। যানবাহনের চাপ মোকাবিলায় এ উন্নয়ন প্রকল্পকে সময়োপযোগী উদ্যোগ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন মহাসড়ক দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আনবে, শিল্পকারখানার উৎপাদন ও পণ্য পরিবহন সহজ করবে এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াবে। তবে এর বিপরীতে রয়েছে বিপুল ব্যয়, দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এবং অতীতে চার লেনের কাজ নিয়ে হওয়া সমালোচনা।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের বিভিন্ন আঞ্চলিক অফিসের তৈরি করা আগের হিসাব অনুযায়ী ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। নতুন পরিকল্পনায় ব্যয় কিছুটা কম হলেও মহাসড়কের গুরুত্বের কারণে এতে অনেক নতুন বৈশিষ্ট্য যুক্ত হওয়ায় ব্যয় এখনো অনেক বেশি।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নকশা অনুযায়ী জানা গেছে, মূলত মহাসড়কটি হবে ছয় লেনের। দুই পাশে দুই লেন করে চার লেনের সার্ভিস লেন হবে। মোট ১০ লেন সড়কের মধ্যে চার লেন থাকবে ডেডিকেটেড। এই চার লেনে সরাসরি ঢাকা থেকে ওঠে সরাসরি চট্টগ্রামে নামবে। কোথাও গাড়ি দাঁড়াবে না। এ চার লেনের দুই পাশে ব্যারিয়ার দেওয়া থাকবে। এই চার লেন ব্যবহার করবে মূল ট্রাফিক। যাত্রাবাড়ী থেকে চট্টগ্রামের সিটি গেট পর্যন্ত ২৩২ কিলোমিটার সড়ক ঘিরেই এই সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়েছে।
ছয়টি জেলা এই মহাসড়কের সাথে সম্পৃক্ত হবে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কুমিল্লা, ফেনী ও চট্টগ্রাম এই ছয় জেলা মহাসড়কটির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে। এর মধ্যে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের ৩৮ কিলোমিটার, কুমিল্লা ও ফেনীর ১২৫ কিলোমিটার, ফেনী থেকে চট্টগ্রাম সিটি গেট পর্যন্ত ৬৯ কিলোমিটার সড়ক ১০ লেন হবে। এর মধ্যে যেসব এলাকায় যানজট তৈরি হতে পারে সেখানে ওভারপাস করা হবে।
সড়কটি বাঁকা অংশও সোজা করা হবে। নির্মাণ-পরবর্তী ১৫ বছর যেন এই মহাসড়কে আর কোনো কাজ করতে না হয়, সে লক্ষ্যেই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে সওজ।
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর নগরীর প্রবেশদ্বার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শুরুতেই সীতাকু- উপজেলা। এ মহাসড়ক ১০ লেনে উন্নীতকরণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে চট্টগ্রামের সীতাকু-ের বাসিন্দারা। তাই ‘সীতাকু- নাগরিক সমাজ’ এর ব্যানারে সরকারের সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তারা তিনটি বিকল্প প্রস্তাবও দিয়েছেন।
‘সীতাকু- নাগরিক সমাজের’ এর সদস্য সচিব শিল্পপতি মাস্টার আবুল কাশেম দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, স্বাধীনতার আগে পাকিস্তান সরকার বর্তমান মহাসড়ক নির্মাণের জন্য মানুষের বাড়িঘর অধিগ্রহণ করে। একইভাবে সরকারি- বেসরকারি স্থাপনা, বড় বড় মিল কারখানা স্থাপনের কারণেও সীতাকু-ের মানুষকে বাপ-দাদার ভিটা হারাতে হয়। সেই ধারা আজও অব্যাহত আছে।
তিনি আরও বলেন, ২০১৬ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ শেষ হয়। বিশেষত এই মহাসড়কের পাশে চলাচলের জন্য সার্ভিস লেন নির্মাণ না করে বন্ধ করে দেওয়া হয় যুগ যুগ ধরে চলা রিক্সা, অটোরিক্সাসহ এলাকার মানুষের যোগাযোগের প্রধান বাহন ধীরগতির যানবাহন। এতে বিপাকে পড়েন এখানকার লাখ লাখ মানুষ। নতুন করে ১০ লেন করা হলে অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এই এলাকার বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিল্প-কারখানা, হাট-বাজার, বাড়িঘর, মসজিদ, মন্দির, কবরস্থান, শ্মশানসহ শত শত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থাপনা চিরতরে হারিয়ে যাবে।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর জানান, ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ মহাসড়কের ডান দিকে সওজ প্রায় ৯০ শতাংশ জমির মালিক হলেও ব্যয় খুব একটা কমানো সম্ভব হয়নি। এ মহাসড়ককে ২০১৬ সালে চার লেনে উন্নীত করতে যেখানে ব্যয় হয়েছিল মাত্র ৩ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা, সেখানে সর্বশেষ উন্নয়নে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৬ গুণ বেশি। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তায় সম্প্রতি সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশা তৈরি করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, মহাসড়ক হবে ছয় লেনের অ্যাকসেস কন্ট্রোল হাইওয়ে অর্থাৎ শুল্ক পরিশোধ করে এই মহাসড়ক ব্যবহার করতে হবে। পাশাপাশি দুই পাশে দুই লেনের সার্ভিস রোড নির্মাণ করা হবে, যাতে সব ধরনের যানবাহন নির্বিঘে চলাচল করতে পারে। এ ছাড়া মহাসড়কে ছয়টি মাল্টি-লেভেল উড়াল ক্রসিং এবং ২০টিরও বেশি উড়াল সার্ভিস ইন্টারচেঞ্জ নির্মাণের প্রস্তাব রয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাখা হবে তিন মিটার প্রশস্ত জরুরি লেন এবং আধুনিক মাল্টি-লেয়ার ইন্টারচেঞ্জ।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) এর চট্টগ্রাম জেলার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ জাহেদ হোসেন দৈনিক জনকণ্ঠকে জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক নিয়ে চলমান সমীক্ষা শেষ হয়েছে। মহাসড়কের সমীক্ষাটি মাঠ পর্যায়ে পরিচালনা করছে অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএমইসির নেতৃত্বে পাঁচ প্রতিষ্ঠান। এর অন্যতম প্রতিষ্ঠান কনসোর্টিয়াম। প্রতিষ্ঠানটি মহাসড়ক প্রশস্তকরণে বিস্তারিত নকশা তৈরি করেছে। যাত্রাবাড়ী থেকে চট্টগ্রামের সিটি গেট পর্যন্ত ২৩২ কিলোমিটার সড়ক ঘিরেই এই সমীক্ষা হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক ও সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. সাব্বির হাসান খান দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের অর্থনীতির প্রাণ হিসেবে বিবেচিত এই মহাসড়ককে সর্বাধুনিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যেই এমন নকশা তৈরি করা হয়েছে। তিনি বলেন, এটি হবে একটি পূর্ণাঙ্গ শুল্ক মহাসড়ক, যাতে দ্রুত ও নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করা যায়। তিনি আরও জানান, মহাসড়কের একটি অংশ পিপিপি নির্মাণের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এডিবি বর্তমানে কোন অংশ পিপিপির আওতায় এবং কোন অংশ ঋণ সহায়তায় নির্মিত হবে সে বিষয়ে কাজ করছে।