ঢাকার দুই সিটির কর্মসূচি অনেক, কার্যকারিতা কম
তরুণ কণ্ঠ রিপোর্ট
প্রকাশিত : ০৬:৪৪ পিএম, ২৬ অক্টোবর ২০২২ বুধবার
দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ। ডেঙ্গুতে সবচেয়ে নাকাল রাজধানী ঢাকা। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও মেয়রদের দাবি ভিন্ন। তারা বলছেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, মশা নিয়ন্ত্রণ করা তাদের কাজ না হলেও ডেঙ্গুরোধে করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞদের দাবি, শুধু হটস্পট নির্ধারণ করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। তাদের মতে, ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতির মূল কারণ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নেওয়া, জনসম্পৃক্ততার অভাব ও জলবায়ু পরিবর্তন।
জানা গেছে, ডেঙ্গু মোকাবিলায় প্রস্তুতি ও করণীয় সম্পর্কে সিটি করপোরেশনসহ জেলা হাসপাতাল এবং সিভিল সার্জনদের সঙ্গে কয়েকবার বসেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সম্প্রতি এ বিষয়ে ঢাকার সরকারি মেডিকেল কলেজ, সিটি করপোরেশনসহ জেলা হাসপাতাল ও সিভিল সার্জনদের প্রস্তুতি সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সব প্রতিষ্ঠানের কাছে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ও সেবার প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি অধিদপ্তর দুই সিটি করপোরেশনে পাঁচটি হটস্পট চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তরে দুটি- মিরপুর ও উত্তরা। দক্ষিণে তিনটি- যাত্রাবাড়ী, মুগদা ও ধানমন্ডিকে ডেঙ্গুর হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, হটস্পট নির্ধারণ করা হলেও চলতি মৌসুমে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম খুব একটা দৃশ্যমান হয়নি। সঠিকভাবে ডেঙ্গু সমস্যা সমাধান না হওয়ায় চলতি বছরের ২০ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারাদেশের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৮ হাজার ৬৯৮ জন। এর মধ্যে শুধু ঢাকায় ২৫ হাজার ৪১৪ জন। এই সময়ে ঢাকায় মারা গেছেন ৬৫ জন। তবে হাসপাতালে ভর্তি হয়নি এমন ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যাও অনেক।
অন্যদিকে, ডেঙ্গু নিয়ে সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, শুধু সিটি করপোরেশন একা নয়, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবার সচেতনতা প্রয়োজন। আমরা নিজেরাই এডিসের লার্ভার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি করছি। আমরা চাই ডেঙ্গুকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখতে। সেজন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা চলছে দাবি করে ডিএনসিসি মেয়র বলেন, সামাজিক আন্দোলন ছাড়া একা কিছু করতে পারবে না সিটি করপোরেশন।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘আমরা এডিস মশার উৎসস্থলগুলো ধ্বংস করছি।আমাদের যদি এক বাসায় তিনবার যেতে হয়, তাহলে কাজটি অত্যন্ত কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু বাসিন্দারা যদি সচেতন হন, তাহলে কাজটি আমাদের জন্য কার্যকর হয়। এখন জনগণ যদি সচেতন না হয়, তাহলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম দুরুহ হয়ে ওঠে।’
ডেঙ্গুর বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সঠিক তথ্য দিচ্ছে না জানিয়ে ডিএসসিসি মেয়র বলেন, অনেক সময় ভুল তথ্যের কারণে এডিস মশার লার্ভা নিয়ন্ত্রণ দুরুহ হয়ে যায়, বিলম্বিত হয়। তিনি সংশ্লিষ্টদের সঠিক তথ্য দেওয়ার আহ্বান জানান।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে জাগো নিউজ। রাজধানীর মিরপুর কাজীপাড়ায় কথা হয় হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এ বছর এই এলাকায় সিটি করপোরেশন থেকে ওষুধ ছিটাতে দেখিনি। বিগত বছরগুলোতে বিকেলে বা সন্ধ্যার আগে মুহূর্তে মশা মারার ওষুধ ছিটাতো সিটি করপোরেশন।
তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা নাইমুল হাসান বলেন, এবছর তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখিনি সিটি করপোরেশনের। তবে, কিছু এলাকায় অভিযান পরিচালনা হয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সিটি করপোরেশনের অভিযান পরিচালিত হয়েছে। সতর্কতার পাশাপাশি জরিমানাও করা হয়েছে।

রাজধানীর বাইরে সিটি করপোরেশন এলাকাগুলোর মধ্যে ডেঙ্গুর প্রকোপ চট্টগ্রাম ও বরিশালে। চলতি বছর ২০ অক্টোবরে চট্টগ্রামে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ৩৩ জন ও বরিশালে ৫২৫ জন। সিটি করপোরেশনের বাইরে কক্সবাজারের অবস্থা বেশ উদ্বেগজনক। এর সঙ্গে পাবনা, যশোর, কুষ্টিয়ার অবস্থাও উদ্বেগজনক।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পর্যালোচনার তথ্যমতে, ডেঙ্গু রোগী আক্রান্তরা হাসপাতালে আসছে বিলম্বে। ডেঙ্গুতে যাদের মৃত্যু হচ্ছে তাদের ৬৪ শতাংশই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তিনদিনের মধ্যে মারা যাচ্ছেন। অন্যদিকে, ডেঙ্গুতে মৃতদের মধ্যে নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। এছাড়া শিশুদের মধ্যেও মৃত্যু বেশি দেখা যাচ্ছে। এ বছর ১৮ বছরের কম বয়সী ৩০ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ঢাকা শিশু হাসপাতালেই ১০ শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
এ নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার জানান, সঠিক সময়ে মশার হটস্পট নির্ধারণ করা না গেলে ডেঙ্গু ছড়াবে। সিটি করপোরেশন সেই ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেনি।
তিনি বলেন, অক্টোবর মাসে এ রকম আগে হয়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এবার থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। স্বচ্ছ পানি জমছে যেখানে ডেঙ্গুর প্রজনন হয়। টানা বৃষ্টি হলে এ রকম হতো না। এবার জ্যামিতিক হারে ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।
ডেঙ্গু নিয়ে সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ডেঙ্গুরোগী বেড়ে গেলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তার চিকিৎসা দিতে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নতুন ইউনিট এবং লালকুঠি হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

মশা মারার কাজ স্বাস্থ্যখাতের নয় জানিয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার প্রতিনিধিদের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এখন মশা কমলে ডেঙ্গুরোগীও কমে যাবে। তখন হাসপাতালে ডেঙ্গুরোগীর চাপও কমে যাবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আহমেদুল কবীর বলেন, এবার ডেঙ্গুর চার ধরনের মধ্যে তিনটিই সক্রিয়। ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার এটি একটি কারণ। জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর অনেকে গুরুত্ব দেন না। পরিস্থিতি বেশ খারাপ হওয়ার পরেই হাসপাতালে যান। এ বিলম্বের কারণে হাসপাতালে আসার পরপরই মৃত্যুর হার বেশি।’
এ নিয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন জানান, ডেঙ্গুর চারটি ধরন আছে: ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪। ২০১৮ সালের পর ডেঙ্গুর ডেন-১ ধরনে মানুষের আক্রান্ত হতে দেখা যায়নি। ২০২১ সালে সব মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল ডেন-৩ ধরনে। এ বছর ডেন-৪ ধরনের প্রকোপ বেশি। আবার ডেন-৩ ও ডেন-১ ধরনেও মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। অর্থাৎ ডেঙ্গুর তিনটি ধরন সক্রিয়। এটি ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি হওয়ার একটি কারণ হতে পারে।
