রোববার   ০৪ মে ২০২৫   বৈশাখ ২০ ১৪৩২   ০৬ জ্বিলকদ ১৪৪৬

নিউমার্কেট এলাকা চাঁদাবাজের হাট

নিজস্ব প্রতিবেদক  

প্রকাশিত : ০১:০৪ পিএম, ২৭ এপ্রিল ২০২২ বুধবার

এ এলাকায় শুধু ফুটপাত ও রাস্তায় পণ্যসামগ্রীর পসরা সাজিয়ে বসছেন প্রায় ৭ হাজার হকার। এদের কাছ থেকে দিনে চাঁদা তোলা হচ্ছে অন্তত ৫০ লাখ টাকা। ১৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কতিপয় নেতাকর্মী এ চাঁদাবাজিতে জড়িত। প্রতিদিন চাঁদা তুলতে ২০ জন লাইনম্যানের তত্ত্বাবধানে পালা করে দায়িত্ব পালন করছেন অন্তত ১০০ জন পেশাদার চাঁদাবাজ। এদের নিয়ন্ত্রণ করেন ১৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহীম হোসেন ইবু।

আর ইবুর ‘গডফাদার’ হিসাবে পরিচিত সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর জসিম উদ্দিন। অভিযোগ আছে, চাঁদার টাকার অর্ধেক যায় স্থানীয় পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তার পকেটে। ফুটপাত ছাড়াও এই এলাকার অন্তত ১০ মার্কেটের মালিক সমিতির নেতারা এক হাজার অবৈধ দোকান বসিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অঙ্কের টাকা। নিউমার্কেট ও আশপাশের এলাকায় সরেজমিন এবং হকার ও ফুটপাত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

হকার ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ-সরষের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ভূত। চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে যাদের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, তাদের যোগসাজশেই বছরের পর বছর ধরে নির্বিঘ্নে প্রকাশ্যে চলছে এ অপকর্ম। এটি দেখার কেউ নেই। তার মনে করেন, একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া এই চাঁদাবাজি বন্ধ করা সম্ভব নয়।

সোমবার বিকাল ৫টা। গাউছিয়া মার্কেটের অদূরে আলপনা প্লাজার সামনে ভ্যানে দাঁড়িয়ে শসা, লেবু, পুঁদিনা পাতাসহ ইফতারসামগ্রী বিক্রি করছিলেন হালিম মিয়া। তার পাশে এসে দাঁড়ালেন হালকা-পাতলা গড়নের ফরসা এক তরুণ। তাকে উদ্দেশ করে হালিম মিয়া বললেন, ‘শুধুই আইলাম। বওনি হয় নাই। পরে আসো।’ তরুণ কিছু না বলে কয়েক পা এগিয়ে আরেকটি ভ্যানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ৫০ টাকা দিয়ে বিদায় করলেন বিক্রেতা। হালিমকে এ প্রতিবেদকের জিজ্ঞাসা-কিসের টাকা তুলছে? ক্ষোভের সুরে বললেন, ‘এগুলো কুত্তা (যারা চাঁদা আদায় করে)। ব্যবসা করলে এই কুত্তাদের খাওন দিতেই অইবো।’ জানা গেছে, রাস্তায় ভ্রাম্যমাণ হকাররা দিনে ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দেন।

আলপনা প্লাজার সামনের সড়ক ধরে গাউছিয়া হয়ে মিরপুর রোডে গিয়ে দেখা গেছে ফুটপাত ছাপিয়ে প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি পর্যন্ত বসেছে অবৈধ দোকানপাট। এসব দোকান নিয়ন্ত্রণে করতে আছে লাইনম্যান। জানা গেছে, দোকান বসানোর জন্য জায়গা ভেদে দিনে ১৫০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হচ্ছে। পণ্যসামগ্রীর ধরন ও জায়গার আকার অনুযায়ী চাঁদার অঙ্ক নির্ধারিত হয়। জামা-কাপড়ের দোকানের সর্বনিু চাঁদা ৩০০ টাকা, সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা। জুতার টুকরি বসানোর জন্য চাঁদা ২০০ টাকা।

ফুটপাতে দাঁড়িয়ে তসবি-টুপি বিক্রির জন্যও হকারকে চাঁদা দিতে হয় ২০০ টাকা। আবার দুটি চৌকি ফেলে গার্মেন্টসামগ্রী বেচাকেনার জন্য চাঁদা গুনতে হয় ২ হাজার টাকা। এক চৌকির দোকান সাজাতে চাঁদার পরিমাণ ১ হাজার টাকা। নিউমার্কেট এলাকায় এ ধরনের হকারের অভাব নেই। সব মিলিয়ে ৭ হাজার হকারের কাছ থেকে গড়ে দিনে ৭০০ টাকা করে তুললে চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৫০ লাখ টাকা।

হকাররা জানান, স্থানীয় পুলিশ সদস্যদের কথা বলে লাইনম্যানরা প্রতিদিন প্রকাশ্যেই চাঁদা তোলে। এ নিয়ে কারও কোনো অভিযোগ নেই। সমঝোতার মাধ্যমেই চলছে বেপরোয়া এ চাঁদাবাজি। তবে চাপা ক্ষোভ ও কষ্ট আছে হকারদের মনে। তাদের ভাষ্য-সরকারি জায়গায় ব্যবসা করছেন তারা। কিন্তু তোলা তুলছে তৃতীয় পক্ষ। ঢাকা কলেজ, চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট ও নিউমার্কেট এলাকার ফুটপাতগুলোতে দোকান বসাতে জায়গা বরাদ্দের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন লাইনম্যান সেলিম ভূঁইয়া।

ঈদের আগ পর্যন্ত ব্যবসার জন্য ফুটপাতে এক টুকরো জায়গা বরাদ্দ দিতে তিনি এককালীন নিচ্ছেন ১০ হাজার টাকা। হকার সেজে তার কাছে জায়গা বরাদ্দ চাইলে তিনি (সেলিম) বলেন, ‘ঈদের জন্য ব্যাপক চাপ। জায়গার অভাব। তাই এখন খরচা একটু বেশিই পড়বে।’ দর কষাকষির পর ৯ হাজার টাকায় ৪ ফুটের একটি জায়গা দিতে রাজি হলেন তিনি। বেশিরভাগ সময় রাত ১০টার পর থেকে চাঁদা তোলার দায়িত্ব পালন করেন সেলিম। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তার অকপট স্বীকারোক্তি-‘দোকান প্রতি ২০০ টাকা তুললে অর্ধেক পুলিশকে দিতে হয়। বাকিটা তাদের। ঈদের টাইম। নানা খরচা আছে। সবার আবদার মেটাতেই এই টাকা তোলা হয়।’

নিউমার্কেট এলাকার সামনের পাঞ্জাবি বিক্রেতা তারেক জানান, ফাঁড়ি পুলিশের পক্ষ থেকে তোলা হয় ৫০ টাকা, পুলিশের টহল টিমের পক্ষ থেকে তোলা হয় ৫০ টাকা। ছাত্রলীগের এক ভাইয়ের পক্ষ থেকে তোলা হয় ৫০ টাকা। এভাবে বিভিন্ন টিম এসে সারা দিনে ৬-৭শ টাকা চাঁদা নিয়ে যায়। তাহলে ব্যবসায়ীরা কিভাবে ব্যবসা করবেন। এ চাঁদাবাজির কারণেই ব্যবসায়ীদের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত থাকে। যার ফলে তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে মাঝে মধ্যেই ব্যবসায়ী ও ছাত্রদের মধ্যে মারামারি হয়।

জানা গেছে, সেলিমের চাঁদাবাজির ‘বস’ ১৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহীম ইবু। তবে ইবুর দাবি, এক সময়ে তিনি লাইন নিয়ন্ত্রণ করতেন। এখন আর তিনি এসবের মধ্যে নেই। স্থানীয় এমপি নিষেধ করায় তারা এ লাইন থেকে সরে গেছেন।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, নিউমার্কেট এলাকা ও এর আশপাশে ফুটপাতে হকারদের অন্তত ১০টি লাইন রয়েছে। এসব লাইন নিয়ন্ত্রণ করেন লাইনম্যান বাচ্চু, কালাম, মঞ্জু, রফিক, আকবর, বাবুল, মিজান, আরিফ, নূরুল, সেলিম ও শাহীন। এদের চাঁদার হিসাব-নিকাশ দিতে হয় ইব্রাহীম ইবু ও সাত্তার মোল্লার কাছে। হিসাব-নিকাশের পর তোলাবাজির অর্ধেক চলে যায় স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের পকেটে। আর অর্ধেক সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর জসিম উদ্দিনসহ তার লোকজন ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন।

তবে চাঁদাবাজিতে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে জসিম উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি চাঁদাবাজির সঙ্গে কখনো জড়িত ছিলাম না। এখনো নেই। ইব্রাহীম, সাত্তার মোল্লাদের লাইন আলাদা। ওদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’

বাংলাদেশ হকার্স লীগের সভাপতি আবুল কাশেম বলেন, নিউমার্কেটের পূর্বপাশের সক্রিয় লাইনম্যানদের সর্দার ইব্রাহীম ইবু ও তার ভাই নূরুল ইসলাম। তাদের ২০ জন লাইনম্যান আছে। আবার একেকজন লাইনম্যানের অধীনে অন্তত ৫ জন করে মোট ১০০ জন চাঁদাবাজ আছে। যারা সরাসরি হকারদের কাছ থেকে চাঁদা তোলেন।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এই চক্রের বাইরেও ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের বেশ কিছু নেতাকর্মী নিজেরাই হকারদের কাছ থেকে চাঁদা তোলেন। এই চাঁদাবাজিতে আধিপত্য বিস্তারের খেলায় ছাত্রলীগ নেতাদের একাধিক গ্রুপ রয়েছে। মঙ্গলবারের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পেছনে ছাত্রলীগের দাপট জাহির করার বিষয়টি কাজ করেছে।

জানতে চাইলে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ নেতা জনি হাসান বলেন, ‘চাঁদাবাজিতে ছাত্রলীগের কেউ জড়িত নেই এটা আমি বলব না। দু-চারজন থাকতেই পারে। ওরা আবার ঢাকা কলেজের চেয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের সঙ্গে বেশি যোগাযোগ রেখে চলে।’

আরও জানা গেছে, শুধু ফুটপাতের হকার নয়, নিউমার্কেট, নিউ সুপার মার্কেটসহ এ এলাকার অন্তত ১০টি মার্কেটে সমানতালে চাঁদাবাজি চলছে। সিটি করপোরেশনের অনুমোদন ছাড়াই এসব মার্কেটে অবৈধভাবে গড়ে তোলা কয়েকশ দোকান থেকে চাঁদা তোলা হচ্ছে মালিক সমিতির নামে। এসব দোকান থেকে এককালীন চাঁদা নেওয়া হয়েছে ৫০ থেকে ১ লাখ টাকা। আর মাসে আদায় করা হচ্ছে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। মার্কেটের নিরাপত্তার নামে এই টাকার একটি অংশ পুলিশকে দেওয়া হয়। অবৈধ দোকান থেকে চাঁদা তোলার কথা স্বীকারও করেছেন মালিক সমিতির কেউ কেউ।

নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম বলেন, ঈদের পর এসব দোকান অপসারণ করা হবে। এসব দোকানদারদের পুনর্বাসন করে অন্যত্র সরাতে হবে। এজন্য বৃহত্তর সিদ্ধান্তে আসতে হবে।

তবে মার্কেট ও ফুটপাত থেকে তোলা চাঁদার ভাগ পাওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। পুলিশের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, নিউমার্কেট এলাকার চাঁদাবাজদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার ফারুক হোসেন বলেন, ফুটপাতের স্টেকহোল্ডার পুলিশ নয়, সিটি করপোরেশন। কারা হকারদের বসানোর জন্য এককালীন চাঁদা নিচ্ছে, কারা দৈনিক ভিত্তিতে চাঁদা নিচ্ছে, চাঁদাবাজদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের সম্পৃক্ততা আছে কিনা তা খুঁজে বের করা হচ্ছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহমেদ বলেন, ফুটপাতে কেউ যদি বেআইনি বা শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজ করে তাহলে তা দেখার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। সিটি করপোরেশনের কাজ ফুটপাতগুলোকে পথচারী বান্ধব করা। আমরা সেটা করে যাচ্ছি।