বুধবার   ১৪ মে ২০২৫   বৈশাখ ৩১ ১৪৩২   ১৬ জ্বিলকদ ১৪৪৬

বাংলা সন প্রচলনে মুসলমানদের অবদান

মুফতি মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম

প্রকাশিত : ০৪:২৩ পিএম, ১৫ এপ্রিল ২০১৯ সোমবার

দিন, সপ্তাহ, মাস ও বছর গণনা পৃথিবীর সূচনা থেকেই চলে আসছে। ‘শাহর’ (মাস) শব্দটি কোরআন মজিদে ২১ বার এবং ‘সানাহ’ (বছর) শব্দটি ২০ বার উল্লেখ করা হয়েছে। মহানবী (সা.)-এর হিজরতের সময় থেকে হিজরি সন গণনা করা হয়। এই দিনটিকে মুসলমানরা বিশেষ গুরুত্ব দেয়। ইংরেজি সন ঈসা (আ.)-এর জন্ম দিবস থেকে গণনা করা হয়। খ্রিস্টানরা উৎসবের সঙ্গে এই দিনটি পালন করে। ইহুদিরা মুসা (আ.) আর বনি ইসরাঈলের ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তিলাভ এবং ফেরাউনের তার বাহিনীসহ নীল নদে ডুবে মরার দিন তথা ১০ মহররমকে সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করে। হিন্দুরা হোলি উৎসবসহ বারো মাসে তেরো পার্বণ পালন করে। আর বৌদ্ধরা কঠিন চীবরদান উৎসব পালন করে। আমরা মুসলমানরা বছরে দুটি ঈদ—ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা পালন করি। 

বাংলা নববর্ষের সূচনা
বাংলা সন মুসলমানদের অবদান, অন্য কারো নয়। মুসলমান আমলে প্রায় পাঁচ শ বছর রাষ্ট্রভাষা ছিল ফারসি আর সাল গণনা করা হতো হিজরি পঞ্জিকা অনুযায়ী। সৌরবর্ষের চেয়ে চান্দ্রবর্ষ ১০ থেকে ১২ দিন কম হওয়ার ফলে কৃষকদের কৃষিসংক্রান্ত কাজে দিনক্ষণের সঠিক হিসাব রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এই সমস্যা উত্তরণে সম্রাট আকবরের নির্দেশে আবুল ফজল ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে ফসলি সনের প্রবর্তন করেন (যা এখন বাংলা সন হিসেবে প্রচলিত)। এতে ৯৬৩ হিজরি সনের মহররম মাসের ১ তারিখ থেকে বৈশাখী সনের প্রথম দিন গণনা শুরু হয় (অর্থাৎ ১ মহররম ৯৬৩ আর পহেলা বৈশাখ ৯৬৩ একই দিন ছিল)। এই নতুন সনের নাম দেওয়া হয় ‘দ্বিন-ই-ইলাহী’ সাল। এই পরিবর্তনের পরও প্রতি চার বছর অন্তর এক দিন ‘লিপ ইয়ার’-এর হেরফের থেকে যায়। এই সমস্যা মেটাতে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে প্রধান করে পাকিস্তান আমলে একটি কমিটি গঠন করা হয়। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সাল থেকে বাংলাদেশে প্রচলিত নতুন ক্যালেন্ডার গ্রহণ করা হয়। এতে প্রতি ইংরেজি ‘লিপ ইয়ার’ বর্ষে বাংলা ফাল্গুন মাসে এক দিন যোগ করে সমস্যার বিজ্ঞানসম্মত সমাধান করা হয়; কিন্তু ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাদের পূজা-পার্বণের দিনক্ষণ নির্ধারণে সহায়ক নয়—এই অজুহাতে আগের নিয়মই বহাল রাখে। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আমাদের তারিখের হেরফেরের এটাই হলো কারণ। ঐতিহাসিকরা বলেন, বাংলা সন চালুর মূল ভিত্তি হলো হিজরি সন। হিজরি সনের বর্তমান বয়স ১৪৪০। বাংলা সন ও হিজরি সনের মধ্যে ব্যবধান মাত্র ১৫ বছর। এই পার্থক্যের কারণ হলো আরবি মাস কোনো কোনো সময় ২৯ দিনে হয়ে থাকে।

নববর্ষের উদ্‌যাপন
মহান আল্লাহ দিবস, মাস, বছর ও সন নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তাই এসব দিবস পালন করতে হবে তাঁরই নির্দেশমতো এবং শরয়ী বিধান অনুযায়ী। মহান আল্লাহ উৎসব পালনের পদ্ধতি সম্পর্কে বলেন, ‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে এবং আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বিনে প্রবেশ করতে দেখবেন, তখন আপনি আপনার পালনকর্তার পবিত্রতা বর্ণনা করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাকারী।’ (সুরা : নসর, আয়াত : ১-৩) তাই মুসলমানদের উৎসব ও আনন্দ ইসলামী শরিয়ত নির্দেশিত পন্থায় হওয়া জরুরি। ইসলামী শরিয়তের সীমারেখার বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
 
মঙ্গল-অমঙ্গল করার মালিক মহান আল্লাহ
বান্দার মঙ্গল ও অমঙ্গল করার মালিক একমাত্র মহান আল্লাহ। সব কল্যাণ ও অকল্যাণ তাঁর কুদরতের হাতে। তিনি ইরশাদ করেন, ‘বলুন হে আল্লাহ! আপনি রাজ্যের মালিক যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান করেন, যার থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নেন। যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করেন, যাকে ইচ্ছা লাঞ্ছিত করেন। আপনার হাতেই কল্যাণ। অবশ্যই আপনি সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ২৬)

মহানবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা যুগকে গালি দিয়ো না, কেননা আমিই যুগ। অর্থাৎ যুগের আবর্তে তুমি বিপদাপদে দুঃখ-কষ্টে পড়লে তা যুগ তোমাকে করেনি, বরং আমিই করেছি। তোমার কোনো ক্ষতি করার ক্ষমতা যুগের নেই। বান্দার ভালো-মন্দ আল্লাহই করে থাকেন।’

সুতরাং কোনো সময় ও সনকে সম্মান জানাতে চাইলে সময় ও সন যিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর নির্দেশিত পথ অনুসরণ করা উচিত।

লেখক : প্রধান ফকিহ, আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী