মঙ্গলবার   ২০ মে ২০২৫   জ্যৈষ্ঠ ৬ ১৪৩২   ২২ জ্বিলকদ ১৪৪৬

অপরাধী শনাক্তে বাড়ছে প্রযুক্তির ব্যবহার

নিজস্ব প্রতিবেদক

কক্সবাজার সৈকত

প্রকাশিত : ১২:১৮ পিএম, ১০ নভেম্বর ২০১৮ শনিবার

একটি মার্কেটের সিসি ক্যামেরা থেকে পাওয়া এক ব্যক্তির কয়েকটি ছবি দিয়ে তাকে ধরিয়ে দিতে অনুরোধ জানিয়ে ফেসবুকে গত ১৮ মে একটি পোস্ট দেন বাড্ডা থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী ওয়াজেদ আলী। দুইদিন পরই ওই লোককে গ্রেপ্তারের খবর নিজের পাতায় শেয়ার করেন ওসি। সেখানে তিনি বলেন, ফেসবুক পোস্ট দেখে এক গণমাধ্যমকর্মী লোকটির পরিচয় জানিয়ে দেন। ওই লোকের বিরুদ্ধে স্বর্ণের দোকান থেকে প্রতারণা করে অলংকার নেওয়ার অভিযোগ ছিল।

কাজী ওয়াজেদের ফেসবুক পাতায় এ রকম সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে ধরিয়ে দেওয়া, পরিচয়হীন মৃতদেহ বা কুড়িয়ে পাওয়া শিশুর পরিচয় জানতে চেয়ে শ’খানেক পোস্ট রয়েছে। যাত্রাবাড়ী থানার দায়িত্বে থাকা এই কর্মকর্তা বলেন, এসব পোস্টের পর ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই তিনি জনগণের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত তথ্যটি পেয়েছেন। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ও কর্মকর্তারাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে এভাবে ব্যবহার করছেন।

অপরাধী শনাক্তকরণ ও সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের ক্ষেত্রে পুলিশ এখন অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর। কোথাও কোনো অপরাধ ঘটামাত্রই আগে শুরু হয় ওই এলাকায় ব্যবহৃত মুঠোফোনের ওপর নজরদারি। সেই মুঠোফোন মালিকদের থেকে বাছাই করা সন্দেহভাজনদের পরিচয় সম্পর্কে তথ্য নিয়ে খোলা হয় তদন্তের খাতা। কেউ হত্যার শিকার হলে তাঁর মুঠোফোন নম্বর আগেই চলে যায় পুলিশের কবজায়। শুরু হয় বিস্তর বিশ্লেষণ। ১০ বছর ধরে এভাবে কয়েক হাজার মামলার সুরাহা করেছে পুলিশ।

পুলিশের বিশেষায়িত তদন্ত সংস্থা পিবিআইয়ের বিশেষ পুলিশ সুপার আহসান হাবিব পলাশ বলেন, মোবাইল ফরেনসিকের সব প্রযুক্তি এখন তাঁদের হাতে রয়েছে। একটি মুঠোফোন বা ডিজিটাল ডিভাইস থেকে মুছে ফেলা তথ্যও তাঁরা বের করতে পারেন। কোনো অপরাধের শিকার বা সন্দেহভাজন ব্যক্তির মুঠোফোন ব্যবহারের অভ্যাস জানলে তাঁর চরিত্র সম্পর্কে অনেকটাই ধারণা পাওয়া যায়।

তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, অপরাধ ঘটামাত্রই এলাকায় কোনো সিসি ক্যামেরা আছে কি না, তা খোঁজা শুরু করেন পুলিশের কর্মকর্তারা। ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অপরাধীদের শনাক্ত করার চেষ্টা হয়। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে গাড়ির নম্বর চিহ্নিত করতে পারে এমন সিসি ক্যামেরা। আর কোথাও ক্যামেরা না থাকলেও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী সন্দেহভাজন ব্যক্তির চেহারা এঁকে ফেলার প্রযুক্তিও পুলিশের কাছে রয়েছে।

এতদিন পর্যন্ত কেবল নির্দিষ্ট সোর্স–নির্ভর হয়ে পুলিশ কাজ করলেও এখন জনগণের সঙ্গে পুলিশের সরাসরি সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে জরুরি হেল্পলাইন ৯৯৯ বা বিশেষ কিছু অ্যাপের মাধ্যমে। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম (সিটি) ইউনিটের অ্যাপ ‘হ্যালো সিটি’ এবং র‍্যাবের ‘রিপোর্ট টু র‍্যাব’–এর মধ্যেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে তথ্য পেয়ে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের ধরতে সুবিধা পাচ্ছে পুলিশ।

আবার প্রযুক্তির ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধও বেড়েছে। আর তা দমনে ‘সাইবার পুলিশিং’ও বেড়েছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, এখন আর পুরোপুরি সোর্সের ওপর নির্ভরতা নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ব্যাংকের লেনদেন—এসব পর্যালোচনা করেও একজন ব্যক্তি সম্পর্কে অনেক ধারণা পাওয়া যায়। মানি লন্ডারিং আইন হওয়ার পর সন্দেহভাজনদের ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনা করার এখতিয়ারও পেয়েছে সিআইডি। এখন মাঠের চেয়ে প্রযুক্তিনির্ভর কাজের পরিমাণই বেশি।

অপরাধী শনাক্তে পুলিশ গড়ে তুলেছে বিশাল তথ্যভান্ডার। প্রায় এক যুগ ধরে কারাগারে যাওয়া সব সন্দেহভাজনেরই আঙুলের ছাপ, ডিএনএ, চোখের আইরিশসহ পাঁচ ধরনের শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য তথ্যভান্ডারে সংগ্রহে রাখা হচ্ছে। এর সঙ্গে অপরাধী বা অজ্ঞাতপরিচয় মৃতদেহ শনাক্তে ব্যবহৃত হচ্ছে জাতীয় পরিচয়পত্রের বিশাল তথ্যভান্ডার। ছদ্মপরিচয়ে থাকা কোনো ব্যক্তি গ্রেপ্তারের পরে আঙুলের ছাপ দেওয়া মাত্রই জাতীয় তথ্যভান্ডার থেকে উঠে আসছে তাঁর আসল পরিচয়। দেশের প্রত্যন্ত এলাকার কোনো থানায়ও তাঁর বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ থাকলে সেটি খুব অল্প সময়েই জানা যাচ্ছে।

এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা বা হত্যার শিকার পরিচয়হীন ব্যক্তির পরিচয় শনাক্তেও আঙুলের ছাপ বিশেষ ভূমিকা রাখছে। ঢাকা মহানগরের মধ্যে থাকা সব ভাড়াটে ও বাড়িওয়ালার তথ্য সংগ্রহ করেছে পুলিশ।

এছাড়াও বোমা উদ্ধার ও অপসারণেও যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তি। এখন ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ যন্ত্রপাতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুটি অত্যাধুনিক রোবট। দূরনিয়ন্ত্রিত রোবটগুলো বোমা খোঁজা, নিষ্ক্রিয় করা থেকে শুরু করে দেয়াল ভাঙা, সিঁড়ি বেয়ে ওঠার মতো কাজও করতে পারে।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ বলেন, পিটিয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের দিন শেষ হয়ে গেছে, সময় এখন প্রযুক্তির। প্রযুক্তি ব্যবহার করে তদন্ত করলে সেটা যেমন নির্ভুল হবে, তেমনি মানুষও হয়রানির হাত থেকে বাঁচবে।