রামপালের বল্লালবাড়িতে আবিষ্কৃত হলো ৮শ বছরের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপ
প্রকাশিত : ০৪:১৭ পিএম, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ রোববার

রামপালের বল্লালবাড়িতে আবিষ্কৃত হলো সেন আমলের রাজবাড়ি। ধারণা করা হচ্ছে, রাজবাড়িটিতে রাজা বল্লাল সেনের রাজপ্রাসাদ ও মন্দির রয়েছে। দু'দিনের পরীক্ষামূলক খননেই মাটির নিচে চাপা থাকা ৮শ বছরের প্রত্নতাত্তি¡ক স্থাপনা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন খননকারীরা।
স্থানীয় এলাকাবাসীরা জানান, মুন্সিগঞ্জ সদরের রামপাল ইউনিয়নের বল্লালবাড়ি এলাকাটি বাংলার সেন রাজাদের রাজধানী 'বিক্রমপুর' হিসেবে পরিচিত থাকলেও সেখানে রাজবাড়ির কোনো চিহ্ন দৃশ্যমান ছিল না। দখল ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাটিতে চারদিকে পরিখা বেষ্টিত এমন বিশাল বাড়িটি আবিষ্কারের জন্য এর আগে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক খনন হয়নি।
'অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন' নামে একটি সংগঠনের উদ্যোগে প্রাচীন নিদর্শন ও প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ উদ্ধারে ২০১১ সাল থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ ও খনন কাজ শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় রামপাল ইউনিয়নের রঘুরামপুর গ্রামে আবিষ্কৃত হয় হাজার বছরের বৌদ্ধবিহার ও টঙ্গিবাড়ীর নাটেশ্বরে বৌদ্ধমন্দির। আর এবার একই ইউনিয়নের বল্লালবাড়ি এলাকায় আবিষ্কৃত হলো সেন আমলের রাজবাড়ির অস্তিত্ব।
খনন কাজের তত্ত¡াবধানে থাকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহ সুফি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বল্লালবাড়িতে খনন কাজে পাওয়া পাথরগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো কোনো স্থাপত্যের ভাঙা টুকরো হতে পারে। বড় আকারের খনন কাজ করলে আরও অনেক কিছু বেরিয়ে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
তার মতে, খনন কাজ শতভাগ সম্পন্ন হলে পুরো একটি রাজধানীর চিত্র ফুটে উঠবে। মোস্তাফিজুর রহমান জানান, গত ২১ জানুয়ারি থেকে দুই দিনের পরীক্ষামূলক খনন কাজ করা হয়। এ কাজে যৌথভাবে অংশ নেয় চীন ও বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক দল। তিনি আরও বলেন, বল্লালবাড়ি খননে যে স্তর পাওয়া গেছে, তাতে এখানে রাজা বল্লাল সেনের রাজ প্রাসাদ ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাড়িটির চারদিকে পরিখা আছে। প্রাসাদের নিরাপত্তায় কৃত্রিমভাবে এটা নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে পরিখার ওপর এখন রাস্তা ও ভবন রয়েছে। মুন্সিগঞ্জ সদরের রামপাল কলেজের পেছন থেকে পরিখাটি স্পষ্ট দেখা যায়। এই পরিখা দেখেই বোঝা যায়, প্রাসাদটি একটি নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে ছিল। জায়গাটি এখন ব্যক্তিমালিকানা সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। তবে মালিকদের অনুমতি নিয়েই খনন কাজ এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ড. নূহ-উল-আলম লেনিন জানান, স্থানীয় প্রশাসন, ভূমি রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় বল্লালবাড়িতে পরীক্ষামূলক খনন শুরু হয়। ২১ জানুয়ারি মাত্র ৯ বর্গমিটার খননেই বেরিয়ে আসে প্রাচীন বসতির গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য স্থাপত্যের চিহ্নরেখা। প্রথম দিনই উন্মোচিত হয় সেন রাজবাড়ির প্রতœতত্ত¡ নিদর্শন পাওয়ার বিপুল সম্ভাবনা। লেনিন জানান, খননকালে প্রাচীন ইটের গাঁথুনি, মৃৎপাত্র এবং চারকোলসহ আরও কিছু জিনিস পাওয়া গেছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রতœনিদর্শনের বয়স বা নির্মাণকাল নির্ধারণ করার জন্য চারকোলের কার্বন-১৪ পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। এখান থেকে পাওয়া চারকোল দিয়েও তাই সহজেই এটার বয়স নির্ধারণ করা সম্ভব।
নূহ-উল-আলম লেনিন বলেন, এ খনন কাজের শুরুতেই প্রায় ৮শ বছরের বাঙালির ইতিহাসের একটি চমকপ্রদ অধ্যায় আবিষ্কারের সূচনা হলো। সেন রাজবাড়ি আবিষ্কারের মাধ্যমে বাঙালির ইতিহাসে আরও একটি অধ্যায় যুক্ত হতে যাচ্ছে। প্রত্নতাত্তি¡ক খনন ও গবেষণা প্রকল্পটির পরিচালক অধ্যাপক ড. সুফী মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, এখানে বর্গাকৃতির একটি দূর্গ ছিল। যতটুকু খনন করা হয়েছে, তাতে স্থাপত্যের নমুনা বেরিয়েছে। এর সঙ্গে জরিপ মিলিয়ে ধারণা করা হচ্ছে, সেন রাজার বাড়িতে একটি প্রাচীর ঘেরা দূর্গের মতো প্রাসাদ ও মন্দির ছিল। প্রত্নতত্ত¡বিদরা জানান, সংগ্রহকৃত চারকোলটি আমেরিকান ল্যাবরেটরি 'বেটা'তে পাঠানো হবে। সেখানে কার্বন পরীক্ষা শেষে সংগ্রহ করা নমুনা কত বছর আগের তা জানা যাবে। ইতিহাসে বল্লাল সেনের একটি সময় রয়েছে। তাই দুই সময় মিলিয়ে অসাধারণ একটি তথ্য ইতিহাসে যোগ হতে পারে।
তিনি বলেন, মুন্সিগঞ্জের বজ্রযোগিনী ও রামপাল অঞ্চলে প্রাচীন নিদর্শন ও প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ উদ্ধারে ২০১১ সাল থেকে প্রতœতাত্ত্বিক জরিপ ও খনন কাজ হাতে নেওয়া হয়। বৌদ্ধ ধর্মের পন্ডিত ও বিশ্বের দ্বিতীয় বুদ্ধ হিসেবে পরিচিত অতীশ দীপংকরের বাস্তুভিটার কাছে ২০১৩ সালে প্রাচীন বৌদ্ধবিহারটি আবিষ্কার হয়। বিহারটি 'বিক্রমপুর বিহার' নামে পরিচিত।
তিনি আরও জানান, আবিষ্কৃত বৌদ্ধবিহারের ৫টি ভিক্ষু কক্ষ এরইমধ্যে উন্মোচিত হয়েছে। একেকটি কক্ষের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ৩ দশমিক ৫ মিটার করে। ধারণা করা হচ্ছে, বৌদ্ধ ধর্মের জ্ঞানতাপস অতীশ দীপংকরের সঙ্গে এই বিহারের সম্পর্ক রয়েছে। বৌদ্ধ বিহারের নকশা অনুযায়ী এর একটি প্রাচীর দেয়াল উত্তর দিকে ও আরেকটি দেয়াল পশ্চিম দিকে ধাবমান বলে নিশ্চিত হয়েছেন খননকারীরা। উন্মোচিত ভিক্ষু কক্ষগুলো বিহারের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত। এ প্রসঙ্গে মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসক সায়লা ফারজানা জানান, খননকাজে জেলা প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতা থাকবে। স্থানীয় বাসিন্দাদেরও সহযোগিতা করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।