মশার শহর গাজীপুর: অতিষ্ঠ নগরবাসী
গাজীপুর ব্যুরো
প্রকাশিত : ০২:০৬ পিএম, ৯ মার্চ ২০২১ মঙ্গলবার
মশার উপদ্রবে অতিষ্ট গাজীপুর মহানগরীর বাসাবাড়ি, দোকানপাট, অফিস-আদালত, ধর্মীয় উপাসনালয় সর্বত্রই। বর্তমানে মশার উপদ্রব ভয়াবহ আকার ধারণ করলেও সিটি করপোরেশনের এব্যাপারে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেই।
শিল্পনগরী গাজীপুরে দিনে কর্মব্যস্ত মানুষের আনাগোনা আর সন্ধ্যা হতেই শুরু হয় মশার অত্যাচার। শ্রমিক অধ্যুষিত এ নগরীতে দিন দিন মশার যন্ত্রণা যেন বেড়েই চলছে। গাজীপুরের বাসিন্দারা যেন মশার কাছে অসহায়, জিম্মি। রাতে তো বটেই দিনের বেলায়ও চলছে মশার অত্যাচার। মশারি টানিয়ে, কয়েল জ্বালিয়ে, ইলেক্ট্রিক ব্যাট কিংবা মশা নাশক ঔষধ স্প্রে করেও সুফল মিলছে না। বিকেল থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যার আজান পরলেই মশার উৎপাত তীব্র আকার ধারণ করে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, সিটি করপোরেশনের ৫৭টি ওয়ার্ডে মশক নিধনের জন্য উন্নত প্রযুক্তির শতাধিক ফগার মেশিন ক্রয় করা হয়েছে। এছাড়াও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ‘ভেহিকেল মাউন্টেইন’ ফগার হমেশিন রয়েছে। এবছর আরও কিছু ফগার মেশিন ক্রয় করার কথা ভাবছে
নগর কতৃপক্ষ। সিঙ্গাপুর থেকে আনা হয়েছে পোল্যান্ডের তৈরি ‘ডেন্টাসাইড ২৫০’ নামক মশার ঔষধ।
সরজমিনে ঘুরে জানা যায়, নগরীর টঙ্গী, গাজীপুরা, বোর্ডবাজার, জয়দেবপুর, কোনাবাড়ি কাশিমপুর, মালেকের বাড়ি, পুবাইলসহ বিভিন্ন এলাকার ড্রেন, পুকুর, ডোবা, নালা-নর্দমার কচুরিপানা ও ময়লা পরিস্কার না করায় সেগুলো এখন মশা উৎপাদনের খামারে পরিণত হয়েছে। তাই অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার নগরীতে মশার উপদ্রব খুব বেশি। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে কিউলেক্স মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ট নগরবাসী।অনেকেই ফ্ল্যাটের জানালায় নেট ব্যবহার করা সত্ত্বেও মশার অত্যাচার থেকে রেহাই পাচ্ছেনা। নিচতলা থেকে শুরু করে দশ তলা পর্যন্ত সর্বত্রই মশার সমান উপদ্রব। নিন্ম শ্রেণীর মানুষদের ভোগান্তি আরও বেশি। সন্ধ্যার পর মশার কামড়ে বাসার ছোট বাচ্চারা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। রাতে ঠিকমতো ঘুমানো যায় না মশার উপদ্রবের কারণে। ঘরে বাইরে বাসা কিংবা অফিস সব জায়গায় মশা। কিন্তু মশক নিধন কর্মীদের মাঠে তেমন কোন কার্যক্রম দেখা যায়না।
নগরীর বোর্ড বাজার এলাকার ব্যবসায়ী মোঃ নাহিয়ান খান হৃদয় অভিযোগ করে বলেন, মশার যন্ত্রণায় দিন-রাত অসহনীয় যন্ত্রণায় রয়েছি। দিনের বেলাও মশার উপদ্রব থাকে, বিকেলে তা বেড়ে যায় বহুগুন। মনে হচ্ছে আমরা কোন মশার শহরে বসবাস করছি। অথচ এমন পরিস্থিতিতে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে একবারও মশার ঔষধ প্রয়োগ করতে দেখছিনা।
টঙ্গী পূর্ব থানা মসজিদের পেশ ইমাম জানান, মশার যন্ত্রণায় মসজিদে নামাজ পড়তে মুসল্লিদের ভীষণ কষ্ট হয়। কয়েল জ্বালিয়ে কিংবা মশা নাশক
স্প্রে করেও এ যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাচ্ছিনা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন মূলত কিউলেক্স মশার উপদ্রব চলছে। স্ত্রী কিউলেক্স মশার মাধ্যমে অসুস্থ ব্যক্তির শরীর থেকে সুস্থ ব্যক্তির শরীরে ফাইলেরিয়া সংক্রমণ হতে পারে। ‘গাদ’ নামে পরিচিত এই রোগের কারণে হাত-পা ফুলে যায়, বারবার জ্বর হয়। এছাড়াও ম্যালেরিয়া ও
চিকনগুনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে বর্ষা মৌসুমে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে পারে এডিস মশার উপদ্রব। প্রতি বছর এডিস মশার কারণে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ও মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। তাই বর্ষা মৌসুমের আগেই মশক নিধনে কার্যকর ভুমিকা নিতে হবে। এছাড়া মশক নিধন কার্যক্রমের পাশাপাশি জনসচেতনতা ও বাড়াতে হবে।
টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাষ্টার হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালের আঙিনা ও ভেতরে মশা ভনভন করছে। কয়েলের ধোয়ায় রোগীদের
কষ্ট হওয়ায় কয়েল ও জ্বালানো যাচ্ছেনা। ফলে অসুস্থ রোগী ও তাদের সঙ্গে থাকা স্বজনরাও মশার যন্ত্রণায় ছটফট করছেন।
হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডাঃ পারভেজ হোসেন বলেন, আমরা নিয়মিত হাসপাতাল ও আশপাশের আঙিনা
পরিস্কার করে থাকি। তবুও মশার উপদ্রব কমছে না। হাসপাতালের রোগীদের জন্য রাতে মশারী দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে সিটি করপোরেশনকে মশক
নিধনের ঔষধ ও ফগার মেশিনের জন্য জানিয়েছি। তারা অতি শিগগিরই হাসপাতালে প্রতিদিন বিকেলে মশার ঔষধ স্প্রে করবেন বলে জানিয়েছেন।
আরএমও আরও বলেন, শীতের শেষে আবহাওয়া উষ্ণ হতে শুরু করেছে। এসময় মশা বংশবিস্তার ঘটায়। ফলে মশার উপদ্রব আনেক বেশি এখন। মশার কামড়ে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকনগুনিয়া, গাদসহ নানা রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বিশেষ করে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। সামনে বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে। তাই মশা নিধনের জন্য সিটি কর্পোরেশনকে এখন থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে বড় ধরনের কোন ক্রাইসিস তৈরি না হয়।
২০১৯ সালে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন যখন ডেঙ্গু মোকাবেলায় হিমসিম খাচ্ছিল ঠিক তখনই নিজ উদ্যোগে সিঙ্গাপুর থেকে ২০০টন মশার ঔষধ এনে সুনাম কুড়িয়েছিলেন গাজীপুর সিটির মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। সেসময় ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন পৌরসভায় বিনামূল্যে সেসব ঔষধ সরবরাহ করেন মেয়র। কিন্তু গত বছর করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে মেয়রের নেওয়া মশক নিধন কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়ে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৫৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর গিয়াস উদ্দিন সরকার বলেন, সর্বশেষ ভার্চুয়াল মিটিংয়ে কাউন্সিলররা মেয়র মহোদয়কে
মশক নিধন কার্যক্রম জোরদার করার জন্য অবহিত করেন। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে এখনও মশক নিধন কার্যক্রম শুরু হয়নি। তাই আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজস্ব ফগার মেশিনের মাধ্যমে গত তিনদিন যাবত মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করছি। আশা করছি খুব
শিগগিরই সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রম শুরু হলে মশার উপদ্রব কিছুটা কমবে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, মেয়র মহোদয়ের নির্দেশে সিদ্ধান্ত হয়েছে প্রতিটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের তত্ত্বাবধানে মশক নিধন কার্যক্রম শুরু হবে। ইতোমধ্যে আমরা প্রত্যেক ওয়ার্ডে ফগার মেশিন ও সিঙ্গাপুর থেকে আনা মশক নিধনের ঔষধ সরবরাহ শুরু করেছি। এছাড়াও ‘ভেহিকেল মাউন্টেইন’ নামক উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ফগার মেশিন রয়েছে যা দিয়ে গাড়িতে করে মশার ঔষধ স্প্রে করা যাবে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই মশক নিধন কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানান তিনি।
