বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৩ ১৪৩১   ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
৫৩১

২১ আগস্ট: নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ভয়াল দিনের স্মৃতি

প্রকাশিত: ২৩ আগস্ট ২০২০  

প্রথমে ছোট একটি গল্প বলি। এক রাজার একটি ছেলে সন্তান জন্ম নিলো। সন্তানটি দেখতো একটু কালো হয়েছিল। রাজ্যময় ছড়িয়ে পড়লো রাজার একটি ছেলে হয়েছে; একটু কালো। পরদিন সকালে রাজ্যের এক মহিলা নদীর ঘাটে পানি আনতে গিয়ে আরেক মহিলাকে বলল- শুনছো নাকি বুজি, রাজার একটা ছেলে হয়েছে, দেখতে কালো।

দ্বিতীয় মহিলা বাড়ি ফেরার পথে অন্য আরেক মহিলাকে বলল- ছি ছি শুনছো নাকি রাজার একটা কালো ছেলে হয়েছে? তৃতীয়জন আরো কয়েকজনকে বলল, শুনছো নাকি রাজার একটা কুচকুচে কালো ছেলে হয়েছে? এরপর ধীরে ধীরে রাজার একটি কাকের মতো কালো ছেলে, রাজার একটি কাকের মতো ছেলে, রাজার একটি কাক হয়েছে- এভাবে কথা রটে গেল। তারপর এ নিয়ে কত কথা যে রাষ্ট্র হতে লাগলো তার ইয়াত্তা নেই! কেউ কেউ বলতে লাগলো, কাকটি উড়ে গেছে, রাজা কাক কোলে নিয়ে বসে আছে, কাকের জন্য সোনা দিয়ে খাচা তৈরি করা হয়েছে, আরো কত কিছু!

আসলে এই যে সামান্য কালো থেকে কাক হওয়ার ঘটনা, এটি খুব স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত এরকম ঘটছে, আমরাও শুনে অভিভূত হচ্ছি। কিন্তু এর ব্যতিক্রম নেই যে তাও নয়, অবশ্যই এর ব্যতিক্রম আছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার দিনের স্মৃতি আমার কাছে এমনি একটি ব্যতিক্রম ঘটনার স্মৃতি। সেদিন আমরা প্রথমে যা শুনেছিলাম, ঘটনা আসলে তার চেয়ে অনেক বড় ছিল। ছিল আরো বেশি ভয়ঙ্কর ও বিভৎস। সেদিন আসলে প্রথমে আমরা বিষয়টিকে সামান্য কালো ভেবেছিলাম, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কাক ছিল।

২০০৪ সাল, আজ থেকে ১৬ বছর আগের কথা। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আমাদের বাসার পুরাতন টিভি পরিবর্তন করা দরকার ছিল। ২১ আগস্ট দুপুরের পরে আমি আর আমার সেজ ভাবী স্টেডিয়াম মার্কেটে যাই একটি টিভি কিনতে। বাসাবো থেকে স্টেডিয়াম মার্কেটে যাওয়ার পথে দেখলাম দলে দলে লোক যাচ্ছে সমাবেশে। আমরা মার্কেটে অনেক শোরুম ঘুরলাম, টিভি দেখলাম। স্টেডিয়ামের পশ্চিম গেটের খুব কাছাকাছি একটি শোরুমে আমরা টিভি পছন্দ করলাম। স্টেডিয়ামের পশ্চিম গেটের খুব কাছাকাছি ওপারেই ছিল সভাস্থল। আমরা টিভির পেমেন্ট দিয়ে অপেক্ষা করছি। ঠিক এমন সময় বিকট সব আওয়াজ শুরু হলো, আমরা সবাই হতচকিত হয়ে গেলাম! পুরো এলাকা কেঁপে উঠতে লাগলো। আমি শোরুমের গেটে এগিয়ে গিয়ে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করতে লাগলাম। দেখলাম মানুষ যে যেদিকে পারছে প্রাণ বাঁচাতে ছুটছে। ৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি কিন্তু কয়েকটা সিনেমাতে দেখেছি প্রাণ বাঁচাতে মানুষ কীভাবে ছুটতে থাকে, আমার কাছে ঠিক সেরকম মনে হচ্ছিল।

মানুষগুলো যে যেভাবে পারছে ছুটছে, পাশাপাশি বাস, কার বা অন্যান্য গাড়ি যা আছে সেগুলো পশ্চিম গেট দিয়ে ঢুকে সামনে কী আছে না আছে তার তোয়াক্কা না করে ভেঙেচুরে পালানোর চেষ্টা করছে। একটার সাথে আরেকটা ধাক্কা লাগছে, গ্লাস ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে, তারপরও ছুটছে, সব গিয়ে রাজউক ভবনের ঠিক বিপরীতে যেখানে এখন হ্যান্ডবল, ভলিবল স্টেডিয়াম এই জায়গাটা তখন ফাঁকা ছিল, সেখানে জমা হতে লাগলো। ধুলা উড়ছে, ধুলায় এলাকা ঘোলাটে হেয়ে গেল। মানুষের চিৎকার, হাহাকার, আর্তনাদ, দোকানগুলোর সাটার বন্ধের আওয়াজে চারিদিকে এক ভয়ঙ্কর পরিবেশ তৈরি হয়ে গেল মুহূর্তে। ছুটে আসা মানুষগুলো ভীত হয়ে স্টেডিয়াম মার্কেটের বিভিন্ন দোকানে ঢুকতে চাচ্ছিল, কিন্তু দোকানদাররা সেটাও করতে দিচ্ছিল না। সবাই সাটার বন্ধ করে দিচ্ছিল। আসলে কেউ কিছু বুঝতে পারছিল না- হয়েছেটা কী? আমি অনেককে জিঞ্জাসা করলাম- কী হয়েছে? সবাই শুধু দৌড়াচ্ছিল আর একটা কথাই বলছিল- ‘শত শত মানুষ মারা গেছে, চারিদিকে রক্ত, লাশ আর লাশ!’

আমরা যে দোকানটিতে ছিলাম তারাও সাটার বন্ধ করে দিলো। এখানেও কয়েকজন ঢোকার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি। আমরা ভিতরে আটকা পড়ে গেলাম। কারণ ঐ মুহূর্তে বের হওয়ার মতো সাহস কারোরই ছিল না। অনেক সময় পরে আমরা বের হয়ে বাসায় ফিরলাম। বাসায় এসে টিভি দেখে আর পরের দিন পত্রিকাগুলো দেখে যা বুঝলাম তাতে আমরা যা ভেবেছিলাম ঘটনা তার চেয়েও আরো বেশি ভয়ঙ্কর আর বিভৎস ছিল। আমরা ভেবেছিলাম সামান্য কালো কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ছিল কাক।

এখন আমরা সকলেই জানি, ১৬ বছর আগে ২১ আগস্ট মুহুর্মুহু গ্রেনেডের বিকট বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। মানুষের আর্তনাদ আর কাতর ছোটাছুটিতে তৈরি হয় এক বিভীষিকা। গোটা দেশ স্তব্ধ হয়ে পড়ে ঐ হামলায়। ২১ আগস্ট, নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ভয়াল দিন। ২০০৪ সালের এই দিনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা, আমাদের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার সমাবেশে অতর্কিতে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। মারা যান আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন। আহত হন শেখ হাসিনাসহ পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মী। অনেক সাংবাদিকও আহত হন।

লেখক:  গাজী তৌহিদুল ইসলাম, জনসংযোগ কর্মকর্তা, অর্থ মন্ত্রণালয়।

এই বিভাগের আরো খবর