শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১   ১১ শাওয়াল ১৪৪৫

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
৪০৪

শূন্যতা, আর কিছু নয়

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশিত: ১২ অক্টোবর ২০১৯  

আগামীকাল বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও আত্মহত্যা প্রতিরোধ’। কোনো পরিবারের একজন সদস্য আত্মহত্যা করলে ওই পরিবারের অবস্থা হয় ঝড়ুপরবর্তী বিধ্বস্ত পরিস্থিতির মতো। ধীরে ধীরে পরিবারটি স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার চেষ্টা করে বটে কিন্তু শূন্যতা থেকেই যায়। তেমনই এক পরিবারের সদস্য লিখেছেন তাঁর বোনকে নিয়ে।
২০১২ থেকে ২০১৫ সাল—তিন বছরের একটি রাতও আমার আম্মা ঘুমাননি। জেগে থেকে অস্থিরতায় পার করেছেন সারাটা সময়। তবে পরিবারের সদস্য হিসেবে এটি আমরা কখনো জানতে পারিনি। ২০১৫ সালে আম্মার স্ট্রোক হওয়ার পর চিকিৎসক যখন তাঁকে একজন মনোরোগের চিকিৎসকে দেখাতে বললেন, সে সময় মনোরোগের চিকিৎসকের সঙ্গে আলাপের সূত্রে আম্মা বলছিলেন, রাতে তিনি ঘুমাতে পারেন না, তখনই আমরা প্রথম জানতে পারলাম, ২০১২ সালে আমার বোনের আত্মহত্যার পর তিন তিনটি বছর রাতে তিনি কখনোই ঘুমাতে পারেননি। বিছানায় শুয়ে এপাশ–ওপাশ করতে করতে কেবল ভেবেছেন, 

তাঁর মেয়ে—যে মেয়েটি অকালে আত্মহত্যা করে জীবনের লেনদেন চুকিয়ে দিল—সে কীভাবে একা একা কবরে ঘুমাচ্ছে?


মনোরোগের চিকিৎসককে আম্মা যে মুহূর্তে কথাগুলো বলছিলেন, ততক্ষণে আমরা বিস্ময়ে বিমূঢ়। তীব্র অপরাধবোধে যেন ন্যুব্জ হয়ে যাচ্ছি। মনে আছে, সে মুহূর্তে বারবার মনে হচ্ছিল, আম্মা মফস্বলে থাকেন আর জীবিকার তাগিদে আমি থিতু হয়েছি রাজধানীতে; আমাদের দুজনের মধ্যে তিন শ কিলোমিটারের দূরত্ব থাকলেও মুঠোফোনে প্রতিদিনের কথাবার্তার কল্যাণে সেই দূরত্ব তো ঘুচিয়েও ফেলেছি, তবু না ঘুমানোর ওই তথ্য আমি এতদিন জানতেই পারিনি! সব শুনে চিকিৎসক বলেছিলেন, আপনার আম্মার স্ট্রোকের পেছনে তিন বছর না ঘুমানোটা একটা বড় কারণ।

তিনি যতই আমাকে এ কথা বলেন, ততই লজ্জায় কুঁকড়ে যাই আমি। চিকিৎসকের সেই শীতাতাপনিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের প্রতি একধরনের বিবমিষা জেগেছিল যেন, প্রবল দুঃখের ভারে সে সময়ে কি মরে যাইনি আমি?

প্রচণ্ড দুঃখে অসাড় হয়ে এমন মরণের দেখা পেয়েছিলাম আরও একদিন—২০১২ সালের ২৭ জুন—যেদিন আত্মহত্যা করেছিল আমার বোন। ওই সকালটিতেও সূর্য উঠেছিল ঠিকঠাক। তবু আমার মনে হচ্ছিল, কালো এ সকাল আঁধারে ঢাকা। ততক্ষণে আমরা জেনে গেছি, আত্মহত্যা করেছে সে। সেদিন হেঁটে হেঁটে আমি আমার বোনের উদ্দেশে যাচ্ছি কিন্তু পা দুটো অবশ। মনের কোণে ভেসে উঠছে একটার পর একটা ছবি: ওর হাসি, ওর সঙ্গে খুনসুটি, অভিমান—পিঠোপিঠি ভাইবোনের বড় হওয়ার কত স্মৃতিই তো থাকে! বারবার মনে হচ্ছে, এ তো আমার সেই সহদোরা, উচ্চশিক্ষার্থে যাকে নিজ হাতে আমি নিয়ে এসেছিলাম এই শহরে—জাহাঙ্গীরনগরে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রত্নতত্ত্বে স্নাতকোত্তর সম্পন্নও করেছিল সে। হলজীবন সমাপ্ত করে অন্য সবার মতো বিসিএস এবং অনান্য চাকরির পরীক্ষায় নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য উঠেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের একটি মেসবাড়িতে। আর নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিল ওরই এক সহপাঠীকে। তবে শ্বশুরবাড়ির লোকজন শেষ পর্যন্ত তাকে মেনে নেয়নি, এমনকি শেষ দিকে স্বামীও সরে গিয়েছিল তার পাশ থেকে।

সবকিছু মনে পড়ছিল আমার। ভাবছিলাম, একটাই তো জীবন, একজীবনের এত উৎসাহ এভাবে শেষ হয়ে যায়! সে যে নেই—এটাই কি সত্য? ওর দুঃসময়ে আমাদের গোটা পরিবারই তো পাশে ছিল। তবু সে চলে গেল, কেন, কী জন্য? ধীর পদক্ষেপে হেঁটে যাচ্ছিলাম বোনের মেসবাড়ির দিকে। সিলিং ফ্যানের সঙ্গে তার ঝুলে থাকা স্তব্ধ শরীর আমি দেখেছিলাম সেদিন। তারপর তাকে বাড়িতেও নিয়ে গিয়েছিলাম, নিয়ে গিয়েছিলাম মায়ের কাছে।

এ ঘটনার পর আর একদিন রাতেও ঘুমাতে পারেননি আমার আম্মা। আর আব্বা? সংসারের প্রতি তিনি কি কিছুটা উদাসীন হয়ে গেলেন? না হলে প্রায় রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে একাকী রাস্তায় তিনি ঘুরে বেড়াবেন কেন?

না, অবস্থানগতভাবে দূরে থাকার কারণে এসবের কিছুই জানতে পারিনি আমি। ঈদে–পার্বণে দু–এক দিনের জন্য যখন বাড়ি যেতাম, দেখতাম, চলে যাওয়া মেয়ের ছবির দিকে প্রায়ই নিঃশব্দে তাকিয়ে আছেন আম্মা। তিনি আর টেলিভিশনও দেখেন না। জিজ্ঞেস করলে বলেন, ‘ভালো লাগে না।’

আদতে বোনের আত্মহত্যার পর আমাদেরও তো ভালো লাগে না কিছুই। একটি অকালমৃত্যু পরিবারের সবাইকে হয়তো মেরে রেখে গেল, মাঝেমধ্যে ভেবেছি এ কথা। তবে পরিবারের সদস্যদের যে মনোরোগের চিকিৎসকের কাছে কাউন্সেলিং করানো তথা তাদের মানসিক স্বাস্থের ব্যাপারে ভাবা উচিত, সে সময় এটা মাথায়ই ঢোকেনি আমার।

মাথায় সেটা ঢুকল ২০১৫–তে, আম্মার স্ট্রোক হওয়ার পর। এরপর সবাই আমরা কাউন্সেলিং করিয়েছিও বটে, কিন্তু আপনজনের অকালমৃত্যুতে যে শোক ঘরে ঢোকে, তা কি কখনো পুরোপুরি তিরোহিত হয়, হতে পারে? মনে হয় না। এ কারণেই বোধ করি অনেকে বলেন, আত্মহত্যা যে করে, সে তো চলেই যায়, আর তার পরিবারের সদস্যরা বেঁচে থেকেও থাকেন জীবন্মৃত। সবকিছুর পরও তাঁদের মনে ক্ষতের মতো জেগে থাকে শূন্যতা। আমরা এখন জীবন্মৃতের মতো বেঁচে আছি, এটা বলব না, আবার এ কথাও বলব না যে আমাদের জীবনে এই সময়ে কোনো আনন্দদায়ক ঘটনা ঘটে না। না, পাকাপোক্ত সিদ্ধান্তের মতো কিছুই বলব না। শুধু বলব, জীবনে যতই দুর্বিপাক, সংকটময় মুহূর্ত এবং অবশাদগ্রস্ততা আসুক না কেন, আত্মহত্যা কখনোই নয়।

এখন ব্যক্তিগত আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে এ লেখার যতি টানব। খুব স্পষ্ট মনে নেই, সম্ভবত হুমায়ূন আহমেদের কোনো একটা চলচ্চিত্র, কোনো এক চ্যানেলে দেখাচ্ছিল—বছর কয়েক আগেও ছবিটি দেখেছিলাম। তার পরও কী এক অজানা আকর্ষণে চোখ যেন সেঁটে রেখেছিলাম টিভি সেটে, কিন্তু এক ঝটকায় হঠাৎই বন্ধ করে ফেলতে হলো চোখ এবং আমার মুখ ফুটে বেরিয়ে এল আলতো আর্তনাদও। কারণ, সিনেমায় তখন দেখানো হচ্ছিল একটি আত্মহত্যার দৃশ্য।

পৃথিবীর সব দৃশ্যই আমার চোখ সহ্য করতে পারে, এই একটি দৃশ্য ছাড়া। কেননা, আত্মহত্যার দৃশ্য দেখলেই আজ, এত বছর পরও আমার মনে হয়, সে আমার বোন তনা নয় তো?