শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১   ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
৯৯৩

মাদার তেরেসা: মানবতার ফেরিওয়ালা

প্রকাশিত: ২৬ আগস্ট ২০২০  

 

‘কেবল সেবা নয়, মানুষকে দাও তোমার হৃদয়। হৃদয়হীন সেবা নয়, তারা চায় তোমার অন্তরের স্পর্শ’— এরকম প্রাণের উক্তি শুধু তিনি মুখেই বলে যাননি, আমৃত্যু আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে সারাবিশ্বের মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন মহীয়সী মাদার তেরেসা। সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে যারা অবহেলিত অনাথ, মাদার তেরেসা তাদেরই বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন, সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে উঠেছেন।

মাদার তেরেসা, যার আসল নাম অ্যাগনিস গঞ্জা বোজাঝিউ। মানুষের হাসিই ছিলো তার আনন্দ, মানুষের কল্যাণই ছিলো তার ব্রত। তাকে বিশ্বশান্তির পায়রা বলে অভিহিত করা হতো। শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মহিয়সী নারী, দুস্থ, দরিদ্র, অসহায়, অবহেলিত মানুষের ত্রাণকর্ত্রীর আজ ১১০ তম জন্মদিন। জন্মদিনে বিশ্ব মানবতার এই দূতকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায় আর ভালোবাসায়।

মহিয়সী এই নারী ১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট পৃথিবীর আলো দেখেন। তিনি একজন আলবেনীয়-বংশোদ্ভূত ভারতীয় ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনী। তিনি ছিলেন নিকোলো ও দ্রানা বয়াজুর কনিষ্ঠ সন্তান। মাত্র ৮ বছর বয়সে বাবা হারান তিনি।

পিতার মৃত্যুর পর তার মা তাকে রোমান ক্যাথলিক আদর্শে লালন-পালন করেন পরম যত্মে। ছোট্ট অ্যাগনেস মিশনারিদের জীবন ও কাজকর্মের গল্প শুনতে খুব ভালোবাসতেন। মাত্র ১২ বছর বয়সেই তিনি ধর্মীয় জীবনযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। ১৮ বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে একজন মিশনারি হিসেবে যোগ দেন সিস্টার্স অব লোরেটো সংস্থায়। এরপর তার মা আর বোনদের সঙ্গে আর কোনোদিন তার দেখাটা পর্যন্ত হয়নি।

এরপর অ্যাগনেস প্রথমে আয়ারল্যান্ডের রথফার্নহ্যামে লোরেটো অ্যাবেতে ইংরেজি ভাষা শিখতে যান। কারণ এ ভাষাই ছিলো ভারতে সিস্টার্স অব লোরেটোর শিক্ষার মাধ্যম। ১৯২৯ সালে ভারতে এসে দার্জিলিংয়ে নবদীক্ষিত হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৩১ সালের ২৪ মে তিনি সন্ন্যাসিনী হিসেবে প্রথম শপথ গ্রহণ করেন। স্কুলে পড়াতে তার ভালো লাগলেও কলকাতার দারিদ্র্যে তিনি উত্তরোত্তর উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে লাগলেন ধীরে ধীরে। ১৯৪৮ সালে তাই দরিদ্রদের মধ্যে মিশনারি কাজ শুরু করেন। প্রথাগত লোরেটো অভ্যাসাদি ত্যাগ করতে শুরু করেন। পোশাক হিসেবে বেছে নেন নীলপাড়ের একটি সাধারণ সাদা সুতির কাপড়। এসময় ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন, বস্তি এলাকায় কাজ শুরু করেন।

১৯৫০ সালে কলকাতায় তিনি মিশনারিজ অফ চ্যারিটি নামে একটি সেবাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর আস্তে আস্তে তিনি সবার নজরে আসতে থাকেন। তৎকালীন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও তার কাজের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তিনি কলকাতার ‘স্বর্গীয় টেরিজা’ (Blessed Teresa of Calcutta) নামে পরিচিত হন।

১৯৭০-এর দশকের মধ্যেই সমাজসেবী এবং অনাথ ও দুস্থজনের বন্ধু হিসেবে তার খ্যাতি সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। সুদীর্ঘ ৪৫ বছর তিনি দরিদ্র, অসুস্থ, অনাথ ও মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের সেবা করেছেন। প্রথমে ভারতে ও পরে সমগ্র বিশ্বে তার এই মিশনারি কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ম্যালকম ম্যাগাজিনের বই ও প্রামাণ্য তথ্যচিত্র ‘সামথিং বিউটিফুল ফর গড’ তার সেবাকার্যের প্রচারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল সেসময়।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার অবদান বাঙালি কখনো ভুলবে না। তিনি দাঁড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের মানুষের পাশে, অকাতরে প্রাণের মায়া ভুলে। একাত্তরের ডিসেম্বরে মাদার তেরেসা খুলনা ও ঢাকার কয়েকটি ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। এসব ক্যাম্পে পাকসেনারা একটানা বাংলাদেশি নারীদের ওপর অত্যাচার করে আসছিল। এসব দেখে মুষড়ে পড়েন তিনি। ঢাকায় ফিরে খোলেন ‘মিশনারিজ অফ চ্যারিটিজ’-এর একটি শাখা। তখন বেশিরভাগ যুদ্ধশিশুকে ঘৃণার চোখে দেখা হতো, ফেলে দেওয়া হতো ডাস্টবিনে। মাদার তেরেসা ওই সময় পরম মমতায় যুদ্ধ শিশুদের কোলে তুলে নেন, পাঠিয়ে দেন কলকাতা, ফ্রান্স ও সুইডেনে।

১৯৭৯ সালের ১৭ অক্টোবর তিনি তার সেবাকার্যের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার ও ১৯৮০ সালে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘ভারতরত্ন’ লাভ করেন। তিনি বিশ্বের ১২৩টি রাষ্ট্রে এইচআইভি/এইডস, কুষ্ঠ ও যক্ষ্মার চিকিৎসাকেন্দ্র, ভোজনশালা, শিশু ও পরিবার পরামর্শ কেন্দ্র, অনাথ আশ্রম এবং বিদ্যালয়সহ মিশনারিজ অব চ্যারিটির ৬১০টি কেন্দ্র নির্মাণে অবদান রেখেছেন। বিভিন্ন ব্যক্তি, সংস্থা ও একাধিক রাষ্ট্রের সরকার তার কাজের ভূয়সী প্রশংসা করে আজও।

১৯৮৩ সালে রোম সফরের সময় মাদার তেরেসার প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়। ১৯৮৯ সালে আবার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর তার কৃত্রিম পেসমেকার স্থাপন হয়। ১৯৯১ সালে মেক্সিকোতে থাকার সময় নিউমোনিয়া হওয়ায় হৃদরোগের আরও অবনতি ঘটে। এই পরিস্থিতিতে তিনি মিশনারিস অফ চ্যারিটির প্রধানের পদ ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাবও করেন। কিন্তু চ্যারিটির নানরা গোপন ভোটগ্রহণের পর তেরেসাকে প্রধান থাকার অনুরোধ করে। অগত্যা তেরেসা চ্যারিটির প্রধান হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন।

১৯৯৬ সালের এপ্রিলে পড়ে গিয়ে মাদার তেরেসার কলার বোন ভেঙে যায়। আগস্টে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। এর পাশাপাশি তাঁর বাম হৃৎপিণ্ড রক্ত পরিবহনে অক্ষম হয়ে পড়ে। ১৯৯৭ সালের ১৩ মার্চ মিশনারিস অফ চ্যারিটির প্রধানের পদ থেকে সরে দাড়ান। ৫ সেপ্টেম্বর চলে যান আমাদের সবাইকে ছেড়ে।

এই বিভাগের আরো খবর