শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৪ ১৪৩০   ১৯ রমজান ১৪৪৫

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
২২১

পূর্ণাঙ্গ রায়ের আগে যেন ফাঁসি কার্যকর না হয়: আপিল বিভাগ

তরুণ কণ্ঠ ডেস্ক

প্রকাশিত: ৭ নভেম্বর ২০২১  

কুষ্টিয়ায় কিশোরী সাবিনাকে ধর্ষণের পর হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি শুকুর আলী আপিলের ‘পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার আগেই তার ফাঁসি কার্যকর প্রক্রিয়া’ শুরুর বিষয়টি আপিল বিভাগের নজরে আনেন আসামিপক্ষের আইনজীবী। পরে শুনানি নিয়ে আদালত এ কথা বলেন।

একই সঙ্গে কিশোরী সাবিনাকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় আসামি শুকুর আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর আপাতত স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। পুলিশের মহাপরিদর্শক ও কারা কর্তৃপক্ষকে এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি আসামি শুকুর আলীর আইনি প্রক্রিয়া মেনে রিভিউ আবেদন করতে বলেছেন আপিল আদালত।

রোববার (৭ নভেম্বর) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ভার্চুয়াল বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতে আসামিপক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট হেলাল উদ্দিন মোল্লা। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। তার সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ।

এদিন আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন একটি মামলা মেনশন করার কথা বলেন। এসময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘হ্যাংগিংয়ের (ফাঁসি) মামলা নিয়ে কত সমালোচনা হচ্ছে। ২০০৬ সালের মামলা শুনতে লিস্টে নিয়ে এসেছি। ২০০৬, ২০০৭ ও ২০০৮ সালের মামলাগুলোর পর ২০১৫ সালের মামলাগুলোও প্রায় শেষ করেছিলাম। এখন দেখছি, ২০১৩ সালের কিছু বাকি রয়েছে।’

একপর্যায়ে আসামি শুকুর আলীর আইনজীবী মো. হেলাল উদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘আসামিকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। অ্যাডভান্স অর্ডারের কারণে তাকে ফাঁসি দিতে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়নি। রিভিউ আবেদন করা হবে, সে পর্যন্ত ফাঁসি যাতে না দেওয়া হয় আদালতের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’

তিন আসামিকে যাবজ্জীবন ও একজনের ফাঁসি বহাল রাখা হয়েছিল জানিয়ে হেলাল উদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘১৮ আগস্ট ওই রায় দেওয়া হয়।’ আদালত বলেন, ‘আবেদন করেছেন?’ তখন আইনজীবী বলেন, ‘ওকালতনামা পাইনি। ডিসির মাধ্যমে এখন ওকালতনামা পেতে ১০ দিন লাগে। অ্যাডভান্স অর্ডারের জন্য আসামির প্রাণভিক্ষার আবেদন খারিজ হয়েছে। এখনো রায়ে সই হয়নি।’

বেঞ্চের একজন বিচারপতি বলেন, ‘অ্যাডভান্স অর্ডার দেওয়া হয়েছে যাদের মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন হয়েছে, তাদের নরমাল সেলে দেওয়ার জন্য। ওই রায় (আপিল বিভাগ) এখনো সই হয়নি।’ ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ বলেন, ‘ফাঁসির জন্য আদালত অ্যাডভান্স অর্ডার পাঠাননি।’

হেলাল উদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘অথচ পুরো অর্ডার চলে গেছে কুষ্টিয়ার বিচারিক আদালতে। সেখান থেকে দণ্ড কার্যকরের জন্য কাশিমপুর কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ এসময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘পুরো রায় পাওয়ার আগে তো হবে (দণ্ড কার্যকর) না।’

পরে প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি আইজি প্রিজন্সকে বলবেন, পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার আগে যাতে দণ্ড কার্যকর করা না হয়।’ এছাড়া আসামিপক্ষের আইনজীবীকে চেম্বারজজ আদালতের কাছে আবেদন দিতে বলেন প্রধান বিচারপতি। এ পর্যায়ে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী বলেন, ‘জেনারেলি একটি কথা বলতে পারেন, আইজি প্রিজন্সকে রায়ে সবার চূড়ান্ত সইয়ের আগে পূর্ণাঙ্গ নয়।’

এপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আইজি প্রিজন্স ফোকাল পয়েন্ট। তাকে বলবেন, পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার আগে যাতে ফাঁসি কার্যকর করা না হয়। তখন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘সচিবকে বলছি, উনাকেও বলে দেবো।’

আসামিপক্ষের আইনজীবী হেলাল উদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘গত ১৮ আগস্ট আপিল বিভাগ শুকুর আলীর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রাখেন। তবে এ মামলায় অন্য তিন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর আপিল বিভাগের রায়ের অগ্রিম অর্ডার পেয়ে কাশিমপুর কারা কর্তৃপক্ষ শুকুর আলীর ফাঁসি কার্যকরে উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর অংশ হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার আবেদনও পাঠানো হয়।’

তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন বাতিল করে দেন। তখন মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের উদ্যোগের কথা আমাদের জানানো হয়। আমরা কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় ও রিভিউ আবেদন দায়ের করার কথা জানাই। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে তো ফাঁসি কার্যকরের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে না। এরপর রিভিউ আবেদনের সুযোগও আসামিকে দিতে হবে। আমি আজ আপিল বিভাগে এসব কথা বলেছি। আপিল বিভাগ শুকুর আলীর ফাঁসি কার্যকর স্থগিত রাখতে বলেছেন।’

শুনানি শেষে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘একজন আইনজীবী আপিল বিভাগে জানিয়েছেন তার আসামির আপিলটা খারিজ হয়েছে। কিন্তু তারা এখনো পূর্ণাঙ্গ রায় পাননি। রায় পেলে তারা রিভিউ করতে পারবেন। কিন্তু তার আগেই নাকি আসামির ফাঁসি কার্যকরের পদক্ষেপ নিয়েছেন কারা কর্তৃপক্ষ। তখন আদালত আইজি প্রিজন্সকে বলতে বললেন যে, পূর্ণাঙ্গ রায়ের আগে যেন ফাঁসি কার্যকর করা না হয়। এছাড়া সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন, পরবর্তীতে বিষয়টি আমাদের কাছে (আদালতে) এলে একটা গাইডলাইন দিয়ে দেবেন।’

অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের কনডেম সেলে পাঠানো হয়। তবে তাদের যখন সাজা কমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়, তখন তাদের কনডেম সেল থেকে সরিয়ে নরমাল সেলে আনা হয়। যাতে সাজা কমা আসামি একটুও যেন কনডেম সেলে থাকতে না হয়। সে অনুসারেই এ মামলায় সাজা কমে যাবজ্জীবন পাওয়া তিনজনের ক্ষেত্রে কনডেম সেল থেকে সাধারণ সেলে নিতে অ্যাডভান্সড অর্ডার দিয়েছিলেন সর্বোচ্চ আদালত।’

জানা গেছে, গত ১৮ আগস্ট কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার লালনগরে সাবিনা (১৩) নামের এক কিশোরীকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে আসামি শুকুর আলীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে তিন জনকে যাবজ্জীবন দণ্ড দেন আপিল বিভাগ।

ওই তিন আসামি হলেন—নুরুদ্দিন সেন্টু, আজানুর রহমান ও মামুন হোসেন। তাদেরকে কনডেম সেল থেকে স্বাভাবিক সেলে স্থানান্তর করতে নির্দেশ দেন।

মামলার বিবরণে জানা গেছে, ২০০৪ সালের ২৫ মার্চ রাতে দৌলতপুর উপজেলার লালনগর গ্রামের আব্দুল মালেক ঝনুর মেয়ে সাবিনাকে (১৩) অপহরণ করে আসামিরা। পরে লালনগর ধরমগাড়ী মাঠের একটি তামাক ক্ষেতে নিয়ে তাকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়।

ঘটনার পরদিন সাবিনার বাবা আব্দুল মালেক ঝনু বাদী হয়ে পাঁচজনকে আসামি করে দৌলতপুর থানায় মামলা করেন। এ মামলার বিচার শেষে ২০০৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড দেন কুষ্টিয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক আকবর হোসেন।

পরে নিয়ম অনুসারে মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য নথি (ডেথ রেফারেন্স) হাইকোর্টে পাঠানো হয়। পাশাপাশি আসামিরা আপিল করেন। এরমধ্যে কামরুল নামের এক আসামি মারা যান। পরবর্তীতে ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি শেষে হাইকোর্ট বিভাগ মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রাখেন। এরপর আসামিরা আপিল করেন। পরে গত ১৮ আগস্টের রায়ে আপিল বিভাগ শুকুর আলীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।

এই বিভাগের আরো খবর