শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১   ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
৩১৭

চীনের মসজিদের শহর : এক অজানা ইতিহাস

তরুণ কণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১০ জুলাই ২০২১  

চীনের বিখ্যাত বাণিজ্যিক নগর সুজু (Suzhou) শহর খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতাব্দিতে স্থাপিত। দেশটির পূর্বাঞ্চল সাংহাইয়ের পাশ্ববর্তী জিয়াংসু প্রদেশে অবস্থিত এশিয়ার দীর্ঘতম ইয়াংজির নদী। এর অববাহিকায় গড়ে উঠেছে সুজু শহর। নদ-নদী, ঝর্ণা, হ্রদ, অনিনন্দ্য সুন্দর ব্রিজ, বাগানসহ শহরের নান্দনিক দৃশ্যে মুগ্ধ হয়ে ঘুরতে আসেন বিশ্বের নানা দেশের পর্যটকরা।

নজরকাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি সুজু শহর তাই প্রাচ্যের ভেনিস নামে খ্যাত। কিন্তু প্রাচীন এই শহরের অলিগলিতে লুকিয়ে আছে ইসলামের ইতিহাসের দীর্ঘ অজানা অধ্যায়। এক সময়ের মসজিদের শহর নামে খ্যাত সুজু শহরটি ইসলামী সংস্কৃতি বিকাশ ও বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণে অনন্য ভূমিকা পালন করেছে যা অনেকের অজানা।

চীনের শিয়ান জিয়াওটং লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আলেসান্দ্রা ক্যাপেল্টিটি একটি প্রবন্ধে সুজু শহরের প্রাচীন মসজিদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরেন। ত্রয়োদশ শতাব্দির মসজিদের স্মৃতিবিজরিত এই শহরে মুসলিম বণিক, সেনাপতি ও শিক্ষিতদের অনেক দল এখানে এসেছিল। মঙ্গোলিয়ান ইউয়ান রাজবংশের সময় অনেক মুসলিমের আগমন হয়। তারাই ছিল প্রথম রাজবংশ যারা ১৩৬৪ সালের মিং রাজবংশের কাছে পরাজিত হওয়া আগ পর্যন্ত পুরো চীন শাসন করে। 

চাইনিজ সম্রাটদের যুগে মুসিলমরা : বিভিন্ন পাথরের ফলক, সম্রাটদের নথি ও লিখিত দলিল থেকে বোঝা যায়, তৎকালীন মুসলিমরা চীনা রাজবংশের সম্রাটদের শাসনকাল দেখেছেন। বিশেষত তাং (Tang) রাজবংশ (৬১৮-৯০৭ খ্রি.), ইউয়ান রাজবংশ (Yuan) (১২৭১-১৩৬৮ খ্রি.), মিং রাজবংশ  (Ming) (১৩৬৮-১৬৪৪ খ্রি.), কিন রাজবংশ (Qing) (১৬৪৪-১৯১২ খ্রি.) ইসলামের প্রতিনিধিদেরকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। ইসলামের নৈতিক শিক্ষার প্রভাবে সম্রাটরা মুসলিমদের শ্রদ্ধা করতেন। তাছাড়া সম্রাজ্যে বৈচিত্রময় সংস্কৃতির মানুষের শান্তিপূর্ণ বসবাস তাদের পছন্দনীয় ছিল। 

সংস্কৃতি বিপ্লবের প্রভাব : চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের (১৯৬৬-১৯৭৬) পর ইসলামকে জোরালোভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর থেকে যেকোনো ধরনের ধর্মীয় কার্যক্রমের কারণে দমন-পীড়ন শুরু হয়। ফলে সেখানকার অধিকাংশ ধর্মীয় স্থাপনা হারিয়ে যায়। তবে অনেক স্থাপনার দরজা, জানালা, স্থাপত্যশৈলীতে তা ফুটে উঠে। তাছাড়া স্থানীয় নথিপত্রের বর্ণনায় এসব তথ্য পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক সময়ে চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের উইঘুর জনগোষ্ঠীকে সরকারি উদ্যোগে ‘আদর্শগত পুনঃশিক্ষা’ কার্যক্রমের মাধ্যমে বিষয়টি আরো জটিল হয়ে পড়েছে। 

১৯ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে চীনের পশ্চিমাঞ্চলে পানথায় ও তুগান সম্প্রদায়ের বিদ্রোহের সময় লক্ষাধিক মুসলিম নিহত হন। মূলত তখন থেকে খ্রিস্টান মিশনারি বিশেষত রুশ স্কলাররা ইসলাম ধর্মকে ক্রমবর্ধমান হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে। পশ্চিমা দেশের অনেক গবেষক ইসলামকে চীনের জাতীয় ধর্ম হতে যাওয়া একটি ধর্ম হিসেবে বিবেচনা শুরু করে। তাঁদের মতে চীন বিশ্বের বৃহত্তর ইসলামী রাষ্ট্র হতে পারে। 

সুজু শহর : প্রাচীন সুজু শহরে এখন এক কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষের বসবাস। সাংহাই থেকে দ্রুতগতির ট্রেনে আসতে মাত্র ২০ মিনিটের পথ। এক সময়ের মুসলিমদের শহর হিসেবে পরিচিত সুজু শহরে এখন কেবল একটিমাত্র মসজিদ বিদ্যমান। তাইপিংফেন নামের একমাত্র মসজিদটি বাণিজ্যিক শহর শিলুতে অবস্থিত। ২০১৮ সালে তা পুনরায় মেরামত করা হয়। এর পাশে রয়েছে ছোট ছোট অনেক রেস্তোরা ও কফিশপ। ১৯৪৯ সালের আগে এখানে বিভিন্ন আকৃতির ১০টির মতো মসজিদ ছিল। এর কিছু ভবনে অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র পাওয়া যায়। 

নারীদের অর্থায়নে নির্মিত মসজিদ :  নারীদের অর্থায়নের নারীদের জন্য নির্মিত বায়োলিনকিয়ান (Baolinqian) মসজিদ। তা কিন রাজবংশ (১৬৪৪-১৯১২ খ্রি.)-এর সময়ে নির্মিত অন্যতম একটি মসজিদ। শহরের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকায় ইয়েং পরিবার (Yang family) খুবই বিত্তবান। এই পরিবারের তিনজন নারী মূল ভবনের ব্যয় নির্বাহ করেন। নারীদের মসজিদ তৈরিতে তারাই অন্যান্য মুসলিম নারীদের থেকে অর্থ সংগ্রহ করে পুরো প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন। চীনের সাংস্কৃতি বিপ্লবের (১৯৬৬-১৯৭৬) সময় ওই মসজিদের গ্রন্থাগারের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পরবর্তীতে তা একটি সাধারণ ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এখন তা দেখলে বুঝা যাবে না যে এক সময় তা মসজিদ ছিল। 

মসজিদ যখন স্কুল হিসেবে ব্যবহৃত : বিত্তবান এই পরিবারের নির্মিত আরেকটি হলো তাইজুনং (Tiejunong) মসজিদ। কিন রাজবংশের সম্রাট গুয়াগকসুর (Guagxu) সময়ে ১৮৭৯ থেকে ১৮৮১ সালের মধ্যে তা নির্মিত হয়। প্রায় তিন হাজার বর্গ মিটার বিশিষ্ট মসজিদটি সুজু শহরে সর্ববৃহৎ ছিল। জুমার নামাজে জন্য বিশাল ১০টি রুমে তিন শতাধিক লোক নামাজ পড়ত। বড় বড় সাতটি উঠোন আছে, যার কোণজুড়ে আছে মিনার ও সম্রাটের স্মৃতিবাহী স্থান। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পর থেকে তা মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে এর বাহ্যিক স্থাপত্যশৈলী থেকে হারিয়ে যাওয়া মসজিদের চিত্র বোঝা যায়। বিশেষত নীল টাইলসে ঢাকা অজুখানা মসজিদের অবয়বকে আরো স্পষ্ট করে। 

অসহায়দের আশ্রয়কেন্দ্র : ১৯০৬ সালে টিয়ানকুকিয়ান (Tiankuqian) মসজিদ নির্মিত হয়। অন্যান্য ধর্মীয় স্থানগুলোর মতো সাংস্কৃতি বিপ্লবকাল থেকে তা এখন কেবল অসহায়-দুস্থদের আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দুই হাজার বর্গমিটারের মসজিদে বিশাল হলরুম, অতিথিশালা ও অজুখানা আছে। প্রধান হলরুমটি একটি সম্মেলনকেন্দ্রের মতো মনে হয়। স্থানীয় ঐতিহাসিক নথিপত্রের তথ্য মতে ওখানে আরবি ভাষায় ক্যালিগ্রাফি করা জিংকো কাঠের তৈরি ফলকও বিদ্যমান, যা বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার ইউ ইউ (Yu Yue) তৈরি করেছেন। শহরের জেড পাথরের মুসলিম ব্যবসায়ীদের অর্থায়নে তৈরি করা হয়, পরবর্তীতে তা পুরো চীনে বিখ্যাত হয়। ১৯২০ সালে এখানের স্কুলে একইসঙ্গে ইসলাম ও কনফুসিয়াস শিক্ষা দেওয়া হত। মসজিদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত স্কুলে মুসলিম শিশুদের আরবি ভাষা ও ইসলামের মৌলিক শিক্ষা শিখানো হত। 

সুজুর প্রাচীন মসজিদ : জিগুয়ান মসজিদ সুজু শহরের সবচেয়ে পুরোনো মসজিদ। শহরের মূলকেন্দ্রের জিগুয়ান (Xiguan) ব্রিজের নাম থেকে মসজিদের নামকরণ করা হয়। ইউয়ান রাজবংশের (১২৭১-১৩৬৮ খ্রি.) শাসনকালে মসজিদটি নির্মিত হয়। ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবার ও ইউনানের প্রদেশের গভর্নর সাইয়িদ আজাল শামসুদ্দিন আল দিন উমর আল বুখারির (১২১১-১২৭৯) আর্থিক সহায়তায় তা নির্মিত হয়। সম্ভ্রান্ত পরিবারটি বুখারা নগরীর খাওয়ারেজম শহর থেকে এখানে হিজরত করেছিল। 

পরবর্তীতে মিং রাজবংশের (১৩৬৮-১৬৪৪ খ্রি.) শাসনকালে মসজিদটি একটি সরকারি দপ্তরে পরিণত হয়। তবে মসজিদের কোনো চিহ্ন আর বাকি নেই। স্থানীয় চাইনিজ নথিপত্রে শুধুমাত্র এর লিখিত অস্তিত্ব পাওয়া যায়। চাইনিজ নথিপত্র থেকে বোঝা যায়, ইউয়ান রাজবংশের শাসনকালে মধ্য এশিয়ার মুসলিমদেরকে সরকারি দপ্তর ও প্রশাসনিক কাজে অগ্রাধিকার দেওয়া হত। ১৯৫০ সালে এই জনগোষ্ঠীল বিপুল সংখ্যক মুসলিমরা হুই সংখ্যালঘু জাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়। চীনের বর্তমান মুসলিমদের অধিকাংশ এ জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত। 

ইসলামী সংস্কৃতিক বিকাশ : মূলত প্রাচীন সুজু নগরী এক সময় ইসলামী সংস্কৃতিচর্চার অন্যতম কেন্দ্র ছিল। চাইনিজ ভাষায় ইসলামের ধর্মীয় গ্রন্থগুলোর অনুবাদ যেসব শহরে হয়েছিল সুজু এর অন্যতম। সুজুর বিখ্যাত শিক্ষাবিদ ও পণ্ডিত জাংজং (Zhang Zhong) ও জো শিকি (Zhou Shiqi) ষোড়শ শতাব্দিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলি ফারসি থেকে চাইনিজ ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন, যা এই শহরকে ইসলামী সংস্কৃতি ও মুসলিম বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অনন্য স্থানে পরিণত করেছিল।

মূলত চাইনিজ ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে সুজু শহর একটি ইসলামী সংস্কৃতির কেন্দ্রে পরিণত হয়। এখানে ইসলামী জ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি কনফুসিয়াস বিষয়েও পাঠদান করা হত। এশিয়া ও চাইনিজ মুসলিমদের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জনাথন লিপম্যান (Jonathan N. Lipman) তাঁর বিখ্যাত বই ‘ফেমিলিয়ার স্ট্রেঞ্জ : অ্যা হিস্টরি অব মুসলিমস ইন নর্থওয়েস্ট চায়না’ -এ সম্পর্কে বিশদ বিবরণ তুলে ধরেছেন। 

সূত্র : দ্য কনভারসেশন