বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৪ ১৪৩০   ১৮ রমজান ১৪৪৫

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
৪৫৬

কোরআনে এক অকৃতজ্ঞ জাতির কথা

তরুণ কণ্ঠ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৫ মার্চ ২০২১  

মহান আল্লাহ এই বিশাল পৃথিবীকে তাঁর বান্দাদের জন্য পরীক্ষাগার বানিয়েছেন। পৃথিবীর বহু জাতিকে তিনি অফুরন্ত নিয়ামত, শক্তি-সামর্থ্য ও ক্ষমতা দিয়েও পরীক্ষা করেছেন। এত কিছু পাওয়ার পরও যারা ঈমান আনেনি, তিনি তাদের আজাব দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছেন। তেমন একটি জাতি ‘সাবা’ গোত্র। মূলত ইয়েমেনের সম্রাট ও সে দেশের অধিবাসীদের উপাধি ছিল ‘সাবা’। তাফসিরে ইবনে কাসিরের বর্ণনামতে, ‘তাবাবেয়া’ সমপ্রদায়ও ‘সাবা’ সমপ্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারা ছিল সে দেশের ধর্মীয় সমপ্রদায়। আল্লাহ তাআলা তাদের সামনে জীবনোপকরণের দ্বার উম্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। তাদের দিয়েছিলেন অফুরন্ত নিয়ামতে ভরা একটি স্বাস্থ্যসম্মত শহর। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অবশ্যই সাবাবাসীদের জন্য তাদের বাসভূমিতে ছিল এক নিদর্শন দুটি উদ্যান, একটি ডান দিকে, অন্যটি বাম দিকে। বলা হয়েছিল, তোমরা তোমাদের রবের দেওয়া রিজিক ভোগ করো এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। উত্তম নগরী ও ক্ষমাশীল রব।’ (সুরা : সাবা, আয়াত : ১৫)

তাফসিরবিদদের মতে, ইয়েমেনের রাজধানী সানা থেকে তিন মনজিল দূরে মাআরেব নগরী অবস্থিত ছিল। এখানে ছিল সাবা সমপ্রদায়ের বসতি। দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকায় শহরটি অবস্থিত ছিল বিধায় উভয় পাহাড়ের ওপর থেকে বৃষ্টির পানি বন্যার আকারে নেমে আসত। ফলে শহরের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে যেত। দেশের সম্রাটগণ উভয় পাহাড়ের মাঝখানে একটি শক্ত ও মজবুত বাঁধ নির্মাণ করলেন। এ বাঁধ পাহাড় থেকে আগত বন্যার পানি রোধ করে পানির একটি বিরাট ভাণ্ডার তৈরি করে দেয়। পাহাড়ি ঢলের পানিও এতে সঞ্চিত হতে থাকে। এই বাঁধে সে যুগের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে এতে পানির বারটি খাল তৈরি করে শহরের বিভিন্ন দিকে পৌঁছানো হতো। সব খালে একই গতিতে পানি প্রবাহিত হতো এবং নাগরিকদের প্রয়োজন মেটাত।

শহরের ডানে ও বামে অবস্থিত পাহাড়দ্বয়ের কিনারায় ফল-মূলের বাগান তৈরি করা হয়েছিল। এসব বাগানে সব রকম বৃক্ষ ফল-মূল প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হতো। কাতাদাহ প্রমুখের বর্নণা অনুযায়ী, একজন লোক মাথায় খালি ঝুড়ি নিয়ে গমন করলে গাছ থেকে পতিত ফলমূল দ্বারা তা আপনা-আপনি ভরে যেত। হাত লাগানোরও প্রয়োজন হতো না। (ইবনে কাসির)

সেই শহরের আবহাওয়া এতটাই বিশুদ্ধ ছিল যে সমগ্র শহরে মশা-মাছি ছারপোকা ও সাপ-বিচ্ছুর মতো ইতর প্রাণীর নামগন্ধও ছিল না। বাইরে থেকে কোনো ব্যক্তি শরীরে কাপড়চোপড়ে উকুন ইত্যাদি নিয়ে এ শহরে পৌঁছালে সেগুলো আপনা আপনি মরে সাফ হয়ে যেত।

উল্লিখিত আয়াতের মাধ্যমে বোঝা যায় যে মহান আল্লাহ তাঁর নবীদের মাধ্যমে তাদের এই কথাও জানিয়ে দিয়েছিলেন যে যদি তারা আল্লাহর ওপর ঈমান আনে এবং তাঁর প্রদত্ত এই নিয়ামতগুলোর শুকরিয়া জ্ঞাপন করে, তাহলে তাদের এই নিয়ামত অক্ষুণ্ন থাকবে এবং তারা জান্নাতে আরো উত্তম নিয়ামত ভোগ করবে। কারণ তোমাদের প্রভু অত্যন্ত ক্ষমাশীল। কিন্তু তারা নবীদের কথা শুনল না। যার ফলে তাদের অর্পিত নিয়ামতের পথ ধরেই তাদের ওপর আজাব এসে গেল। পবিত্র কোরআনে সেই আজাবের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, অতঃপর তারা অবাধ্য হলো। ফলে আমরা তাদের ওপর প্রবাহিত করলাম ‘আরেম’ বাঁধের বন্যা এবং তাদের উদ্যান দুটিকে পরিবর্তন করে দিলাম এমন দুটি উদ্যানে, যাতে উৎপন্ন হয় বিস্বাদ ফলমূল, ঝাউগাছ এবং সামান্য কিছু কুলগাছ। (সুরা : সাবা, আয়াত : ১৬)

তারা যখন আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করতে অস্বীকার করল, তখন আল্লাহ তাদের বাঁধভাঙা বন্যা দ্বারা ধ্বংস কারার ইচ্ছা করলেন, তাদের শক্তিশালী সেই বাঁধের গোড়ায় অন্ধ ইঁদুর নিয়োজিত করে দিলেন। তারা এর ভিত্তি দুর্বল করে দিল। বৃষ্টির মৌসুমে পানির চাপে দুর্বল ভিতের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি হয়ে গেল। অবশেষে বাঁধের পেছনে সঞ্চিত পানি গোটা উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়ল। শহরের সব ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত হলো এবং গাছপালা উজাড় হয়ে গেল। পাহাড়ের কিনারায় দুই সারি উদ্যানের পানি শুকিয়ে গেল। কোনো কোনো বর্ণনাকারীর মতে বাঁধের কাছে ইঁদুর দেখে তারা বিপত্সংকেত বুঝতে পারল। ইঁদুর নিধনের উদ্দেশ্যে তারা বাঁধের নিচে অনেক বিড়াল ছেড়ে দিল, যাতে ইঁদুরগুলো বাঁধের কাছে আসতে না পারে। কিন্তু আল্লাহর সিদ্ধান্ত প্রতিরোধ করার সাধ্য কার? বিড়ালগুলো ইঁদুরের কাছে হার মানল এবং ইঁদুরগুলো বাঁধের ভিত্তিতে প্রবিষ্ট হয়ে গেল।

বন্যা-পরবর্তী সময়ে তাদের সেই ঐতিহাসিক বাগানের চেহারাই পাল্টে গেল। মূল্যবান ফল-মূলের বৃক্ষের পরিবর্তে তাতে এমন বৃক্ষ উৎপন্ন করলেন, যার ফল ছিল বিস্বাদ। এভাবে মহান আল্লাহ তার নিয়ামতের অস্বীকারকারীদের কাছ থেকে নিয়ামত ছিনিয়ে নেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘ওই শাস্তি আমি তাদের দিয়েছিলাম তাদের কুফরির (অকৃতজ্ঞতাভরে সত্য প্রত্যাখ্যানের) কারণে। আর অকৃতজ্ঞ ছাড়া আমি আর কাউকে এমন শাস্তি দিই না।’ (সুরা সাবা, আয়াত : ১৭)

তাই জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে মহান আল্লাহর নিয়ামতগুলোর শুকরিয়া জ্ঞাপন করা উচিত। তাঁর আদেশ-নিষেধগুলো আন্তরিকভাবে পালন করা উচিত। তাহলে তিনি নিয়ামত আরো বাড়িয়ে দেবেন।