বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৪ ১৪৩০   ১৮ রমজান ১৪৪৫

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
২৫৩

একজন সাহসী হাসিনার গল্প

লীনা পারভীন 

প্রকাশিত: ২০ নভেম্বর ২০১৮  

লেখাটা কোথা থেকে শুরু করবো? পিতার ইতিহাস নাকি একজন মায়ের গল্প কিংবা একজন সাহসী নারী রেনুর গল্প নাকি একজন হাসিনাকে নিয়েই লিখবো? তাহলে কেন রেহানাকে নিয়ে নয়? যদি হাসিনাকে নিয়েই লিখি, তাহলে কোন হাসিনা? একজন রাষ্ট্রপতির বড় কন্যা হাসিনা নাকি রেহানার প্রাণপ্রদ্বীপ বোন হাসিনা? নাকি পিতামাতাহীন অসহায় দিশাহারা দুই বোনের গল্প। যারা ভেঙে পড়েও উঠে দাঁড়ান। যারা দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে ফিরে এসেছিলেন।

একজন কন্যা হাসিনা, একজন বোন হাসিনা, একজন জননেত্রী হাসিনা, একজন সাধারণ নারী হাসিনা— যার জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাতে চান টুঙ্গিপাড়ায় নিজের গ্রামে। একজন মানুষের জীবন এত বিস্তৃত, এত সংগ্রামের, এত প্রতিজ্ঞার, এত ত্যাগের আর এত দায়িত্বের—বিষয়টি হয়তো কখনোই এমনভাবে অনুভূত হতো না, যদি না সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ডকু ড্রামা ‘হাসিনা: অ্যা ডটারস টেল’ দেখার সুযোগ না পেতাম।
একজন শেখ মুজিবের নাম বেঁচে আছে এই বাংলাদেশের জনক হিসেবে। কিন্তু আমরা সেই অকৃতজ্ঞ জাতি, যারা স্বাধীনতার কিছু বছর পরেই হত্যা করেছি আমাদের সেই জনককে। অনুশোচনার বিষয় হচ্ছে সেই হত্যাকে জায়েজ করা হয়েছিল ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে। হত্যার বিচার বন্ধ করা হয়েছিল আইন করে। পিতা হত্যার বিচার চাইতে পারেনি দুই কন্যা। এমনকি শেখ মুজিবের কন্যা হওয়ার অপরাধে দেশে ফেরার অনুমতি পায়নি। বিদেশের মাটিতে দু’জন অসহায় মানুষ সেইদিন রাতেও যারা ছিল সবার চোখের মণি, দেশে-বিদেশে যাদের ছিল সম্মানের স্থান। নিমিষেই একই রাতের মধ্যে তারা হয়ে গেলেন আশ্রয়হীন, সহায় সম্বলহীন। অপরিচিত দেশে কেউ যখন তাঁদের দায়িত্ব নিতে চাইছিলেন না, তখন কেমন ছিল লড়াইটা? এমনই সব গল্প উঠে এসেছে এ ডকু ড্রামায়।

শেখ মুজিব হত্যা, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার বেঁচে যাওয়ার তথ্যটি এদেশের মানুষের জানা থাকলেও কেমন করে দীর্ঘ জীবন সংগ্রামে তারা বেঁচে ছিলেন, কতটা অবহেলায়, কতটা অসহায়ভাবে—সে গল্পটি ছিল সবসময় অন্ধকারে। তারাও জানাতে চাননি আর আমরাও জানতে চাইনি কোনোদিন। ৭১ সালে ভারতে আশ্রিত ছিল প্রায় এক কোটির ওপরে বাংলাদেশি। ৭ কোটির মধ্যে ১ কোটির আশ্রয়স্থল ভারতে কোনোদিন বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যিনি বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তার দুই কন্যাকেও আশ্রিত হিসেবে ভারতে থাকা লাগবে, এটি কেউ কি কখনও কল্পনাতেও ভাবতে পেরেছে? ইন্দিরা গান্ধী যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রধান আশ্রয়দাতা ও সহায়তাকারী দেশের রাষ্ট্রনেতা ছিলেন, তিনিও কী ভেবেছিলেন কখনও?

ইতিহাসে পাতায় পাতায় কতকিছু অজানা থাকে আমাদের। আমাদের প্রজন্ম কতটাইবা জেনেছে সেই ইতিহাসকে? শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে দিল্লিতে থাকতে হয়েছিল নাম পরিবর্তন করে। এই যন্ত্রণা বোঝার মতো ক্ষমতা আমাদের কারও নেই। কোনোদিন হবেও না।

একটি জাতির পিতার পরিবারে টিকে থাকা দুই সন্তান একসময় নিজ পরিচয় গোপন করে থাকতে হয়ে অন্য একটি দেশে! কী নিষ্ঠুর সেই ইতিহাস!

আমরা যারা খুব সহজেই আজকে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে নিয়ে সমালোচনা করে ফেলি তারা কী কখনও নিজেকে সেই দুই জনের জায়গায় বসাতে পারবো? ভাবতে পারবো—কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পিতা-মাতা, ভাই-বোন হারিয়ে ফেলা দু’জন মানুষ, যারা এখনও বেঁচে আছেন। তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন এই দেশকে রক্ষায়, এই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কতটা সাহসী হলে সম্ভব এই কাজটি করার মতো নিজেকে প্রস্তুত রাখা?

তাদের দুজনের কেউই কিন্তু দলীয় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন না। শেখ হাসিনা ছাত্র রাজনীতি করলেও পরবর্তী জীবনে তিনি একজন গৃহিনী হিসাবেই ছিলেন। দুই সন্তানের জননী শেখ হাসিনা চাইলেই পারতেন এই দেশকে ঘৃণা করতে, এই দেশ তাদেরকে যা দিয়েছে, কেড়ে নিয়েছে সবকিছু। এমনকি তার পরিচয়টুকুও কেড়ে নিয়েছিল।

যেই শেখ হাসিনা তার পরিবারে পরিচিত ছিলেন একজন অলস মানুষ হিসাবে, তার রুমকে ডাকা হতো আলসে খানা নামে, সেই হাসিনা এখন দিন-রাত এক করে পরিশ্রম করেন কেবল দেশের কাজে। ব্যক্তিগত বলে এখন তার আর কিছুই নেই। আরাম-আয়েশ, সুখের জীবনকে ত্যাগ করে তিনি হাতে তুলে নিয়েছেন নিজের দলকে বাঁচানোর দায়িত্ব।  যার মাধ্যমে আজ তিনি এই বাংলাদেশের একমাত্র ত্রাণকর্তাও বটে। একজন শেখ মুজিবের শূন্যস্থান যেন তিনি পূরণ করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। বঙ্গবন্ধু যেমন নিপীড়িত, দুঃখী মানুষের আশ্রয়স্থল ছিলেন, শেখ হাসিনাও আজ  সাধারণ মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছেন।

কতটা ত্যাগ, সংগ্রাম, লড়াই, পরিশ্রম করে একজন সফল রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন শেখ হাসিনা, সেই গল্প প্রতিটি মানুষের জন্যই শিক্ষণীয়। যাদের উদ্যোগে এই ডকুড্রামা নির্মাণ হয়েছে তারা সত্যিকার অর্থে একটি ঐতিহাসিক কাজ করে ফেলেছেন। বর্তমান প্রজন্ম এমনকি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হাসিনা ‘অ্যা ডটারস টেল’ হয়ে থাকবে ইতিহাসের একটি দলিল হিসেবে।

এই ডকু ড্রামার পরিচালককে ব্যক্তিগতভাবে আমি ধন্যবাদ দিতে চাইবো। কারণ এই প্রজন্মের একজন হয়ে তিনি যে দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছেন, সেটিও প্রশংসার। তিনি যে প্রজন্মের ধারক, আমিও সেই প্রজন্মেরই একজন। আমরা বেড়ে উঠেছি বিকৃত ইতিহাসে হাত ধরে। শৈশব-কৈশোরে পরিবারের কখনও শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ভালো কিছু শুনিনি বা পড়িনি। একজন শেখ হাসিনাকে তাই ধারণ করাটাও অত সহজ হওয়ার কথা নয়। ছবিটি দেখলেই বোঝা যায়, পরিচালক কেবল একজন শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যাকে নিয়ে নয় বা আওয়ামী লীগের হয়ে কাজটি করেননি। তিনি ধারণ করার চেষ্টা করেছেন একজন যোগ্য কন্যাকে, তিনি অনুভব করেছেন একজন শেখ হাসিনা কতটা বেদনার মাঝ দিয়ে নিজেকে টেনে চলেছেন। একজন শেখ হাসিনা কেমন করে হয়ে উঠেছেন একজন রেহানার আশ্রয়স্থল থেকে সবার আশ্রয়স্থল। এগুলো দেখাতে হলে বিশ্বাস প্রয়োজন।

সঠিক বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনতে, ঐক্যবদ্ধ বাঙালিকে খুঁজে পেতে, সঠিক ইতিহাসকে সবার জন্য উন্মুক্ত করতে এমন কাজ আরও বেশি হওয়ার প্রয়োজন আছে। যতটা পিছিয়ে দিয়েছিল ঘাতকেরা আমাদের প্রজন্মের হাত ধরে, ঠিক তার চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে এগিয়ে যাবো আমরা। একজন শেখ হাসিনাকে যেন আমরা নিজের মতো করে ধারণ করতে পারি, তার কষ্টকে নিজের মধ্যে নিয়ে বুঝতে শিখতে পারি, তিনি কেন জীবনের বিনিময়ে টেনে নিয়ে চলেছেন এই ভাঙাচোরা দেশটিকে। যুগে যুগে শেখ হাসিনার মতো মানুষ জন্ম নিক, তবেই দায়মুক্ত হবে এই দেশ এই মাটি।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরো খবর