বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৪ ১৪৩০   ১৮ রমজান ১৪৪৫

ভারতের তৈরি করোনার সম্ভাব্য ভ্যাকসিন ঘিরে চলছে বিতর্ক

প্রকাশিত : ১০:৫৬ এএম, ৬ জুলাই ২০২০ সোমবার

 

ভারতের তৈরি নভেল করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে গতকাল রোববার থেকে শুরু হয়েছে বিতর্ক। গতকাল বিকেলে ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়, ভারতে তৈরি কোনো ভ্যাকসিনই ২০২১ সালের আগে পাওয়া যাবে বলে তারা মনে করছে না। এমন বক্তব্য আসতেই হইচই পড়ে যায়। যদিও কয়েক মিনিটের মধ্যে দ্রুত সে বক্তব্য মুছে নতুন করে প্রবন্ধটি প্রকাশ করা হয়। কিন্তু তাতে ধোঁয়াশা কাটেনি।

ভারত বায়োটেক সংস্থার সঙ্গে হাত মিলিয়ে আগামী ১৫ আগস্টের মধ্যে ভারতবাসীর জন্য করোনার ভ্যাকসিন আনা হবে বলে গত ৩ জুলাই ঘোষণা করেছিল দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর)। কিন্তু যে ভ্যাকসিনের প্রয়োগ এখনো মানবদেহে পরীক্ষিত হয়নি, জানা যায়নি সেটির ভাল-মন্দ, সে ভ্যাকসিন কীভাবে পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে দিনের আলো দেখতে পারে, তা নিয়ে তখন থেকেই শুরু হয় প্রবল বিতর্ক। সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকা এ খবর জানিয়েছে।

ভারত সরকারের অযথা তাড়াহুড়ো নিয়ে মুখ খোলেন দেশটির বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের বড় অংশ। সময় বেঁধে ভ্যাকসিন আবিষ্কারকে নজিরবিহীন বলে ব্যাখ্যা করে ইন্ডিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সেস। এমনকি অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সের (এইমস) পরিচালকের মতো সরকারি পদে থাকা শীর্ষ চিকিৎসকও এভাবে ঘোষণা দিয়ে প্রতিষেধক বাজারে আনার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

ভ্যাকসিন নিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটাতে গতকাল ভ্যাকসিন গবেষণা সংক্রান্ত চিকিৎসক সাবেক আমলা টি ভি ভেঙ্কটেশ্বরমের একটি প্রবন্ধ প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোর (পিআইবি) ওয়েবসাইটের প্রেস বিবৃতি অংশে প্রকাশ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। যাতে বলা হয়, ভারত বায়োটেক সংস্থার ‘কোভ্যাক্সিন’ ও জাইডাস ক্যাডিলা সংস্থার ‘জাইকড-ডি’ ভ্যাকসিন মানবদেহে প্রয়োগের অপেক্ষায় রয়েছে। তবে ওই প্রবন্ধে ভেঙ্কটশ্বরম এও লেখেন, ‘২০২১ সালের আগে ভ্যাকসিনগুলো জনগণের মধ্যে প্রয়োগ করার অবস্থায় পৌঁছাবে না।’ এই লাইনটি নিয়েই শুরু হয় হইচই। প্রশ্ন ওঠে, ভ্যাকসিন প্রশ্নে আইসিএমআরের বেঁধে দেওয়া সময়সীমার সঙ্গে কি তাহলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মতপার্থক্য রয়েছে? তাহলে কি সরকার স্বীকার করে নিল যে, এত অল্প সময়ে ভ্যাকসিন তৈরি অসম্ভব? এমন জল্পনা-কল্পনার মুখেই প্রবন্ধটি পিআইবি ওয়েবসাইট থেকে মুছে দিয়ে কিছু সময় পর সেটি আবারও পোস্ট করা হয়। কিন্তু এবারের লেখায় ‘২০২১ সালের আগে ভ্যাকসিনগুলো জনগণের মধ্যে প্রয়োগ করার অবস্থায় পৌঁছাবে না’ — এ অংশটি বাদ পড়ে।

এ বিষয়ে সরকারি সূত্রের বক্তব্য, যাঁর বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে, তিনি করোনাসংক্রান্ত কোনে সরকারি উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত নন। তিনি তাঁর মতামত জানিয়েছিলেন মাত্র। যেটি পিআইবি ওয়েবসাইটে পোস্ট করা হয়েছে। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, ওই ব্যক্তির মতামতই যদি প্রকাশ করার কথা বলা হয়, তাহলে তাতে হস্তক্ষেপ করে সংশোধিত বিবৃতি প্রকাশ করা কেনকরা হলো? ওই চিকিৎসক যা মনে করেছেন, তাই রেখে দেওয়া উচিত ছিল। এ ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থানের সঙ্গে চিকিৎসকের অবস্থানের মতান্তর হওয়ায় পরিকল্পিতভাবে বিতর্কিত অংশটুকু ছেঁটে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ। বিরোধীদের মতে, এটা ব্যক্তিগত মতপ্রকাশে বাধাদান। এরপর সরকারের সূত্র পাল্টা জানায়, পিআইবি যখন সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অংশে কিছু পোস্ট করে, তখন তা সরকারের বক্তব্য হিসেবেই ধরা হয়।

ভ্যাকসিন আনার প্রশ্নে তাড়াহুড়ো নিয়ে ঘোর আপত্তি জানিয়েছেন এইমসের পরিচালক রণদীপ গুলেরিয়াও। কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে ভারত সরকারের ১০টি ক্ষমতাসম্পন্ন দলের একটির চেয়ারম্যান গুলেরিয়ার মুখ খোলা সরকার ও আইসিএমআরের জন্য অস্বস্তিকর।

সংবাদমাধ্যমে গুলেরিয়া জানিয়েছেন, ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই এত দ্রুত করোনার ভ্যাকসিন আনা ঠিক হচ্ছে না। কারণ কোনো ভ্যাকসিনের গবেষণা থেকে বাজারে আসতে অন্তত ১২ থেকে ১৮ মাস লাগে। অল্প মানুষের ওপর ভ্যাকসিন প্রয়োগ করলে ক্ষতিকর প্রভাব কম বোঝা যায়। তাই আরো বেশি সংখ্যক মানুষের ওপর ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা উচিত ছিল বলে তিনি মনে করেন।

এ ছাড়া ভ্যাকসিন নিয়ে আইসিএমআরের সময় বেঁধে দেওয়ার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস (আইএএসসি)। সংস্থাটির সভাপতি গবেষক পার্থপ্রতিম মজুমদার এক বিবৃতিতে লেখেন, যে সময়সীমা বলা হচ্ছে, তা অবাস্তব। দেশের মানুষকে অযথা আশা দেখানো হচ্ছে। গবেষণার সময় প্রথম ধাপে ভ্যাকসিনের নিরাপত্তা, দ্বিতীয় ধাপে সেটির কার্যকারিতা ও তৃতীয় ধাপে কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবকের ওপর প্রয়োগ করে নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা দেখা হয়। যা সময়সাপেক্ষ। তা ছাড়া একটি পর্ব শেষের পর সে রিপোর্ট সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ করে দেখে তারপর পরবর্তী ধাপে যাওয়া যায়। প্রথম ধাপে স্বেচ্ছাসেবকদের ওপর ভ্যাকসিনের নেতিবাচক প্রভাব পড়লে দ্বিতীয় ধাপ শুরু করা যায় না। তাই আগে থেকেই এভাবে সময় বেঁধে দেওয়া অযৌক্তিক ও নজিরবিহীন বলে জানান পার্থপ্রতিম মজুমদার।