শিক্ষকতার পাশাপাশি উদ্যোক্তা ও মানবিক নোবেল
আবু নাঈম নোমানঃ
প্রকাশিত : ০৪:৫৩ পিএম, ১ জুলাই ২০২০ বুধবার

কখনো বাম হাতে ডাস্টার ডান হাতে চক, আবার কখনো একহাতে কাস্তে অন্য হাতে নিজ বাগানের ফল কাটা। করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের মাঝে গণসচেতনতা তৈরী করতে ছুটে চলা হাটে মাঠে এবং ঢাকা থেকে আসা সর্বস্তরের মানুষের বাড়িতে। আবার কখনো কখনো ত্রাণের বস্তা ও টিন নিয়ে ছুটে চলা মানুষের দ্বারে দ্বারে।
এতক্ষণ যার কথা বলতে ছিলাম,
নাম সাব্বির আহম্মেদ নোবেল, পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক। তিনি চর কাজল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক ।
নোবেলের জন্ম পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলার চর কাজল গ্রামে। ছোট বেলা থেকেই গ্রামের সবুজ শ্যামল পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন। মানুষের দুঃখ কষ্ট গুলো দেখেছেন খুব কাছ থেকে। তার পিতা মৃত সুলতান আহম্মেদ স্যার, তিনিও শিক্ষকতা পেশায় ছিলেন। বিচক্ষণ ও দক্ষ সফল সিনিয়র সহকারী শিক্ষক হিসাবে তার খ্যাতি রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বাবার মৃত্যুর পর তিনি তার আদর্শে কিভাবে গ্রামের সহজ সরল মানুষদের পাশে দাঁড়ানো যায় এবং দরিদ্র ও হত দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা যায় তা নিয়ে ভাবতে থাকেন। তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন মানবিক কাজ করে যাচ্ছেন। এমন কি তিনি একজন সফল উদ্যোক্তাও। নোবেল মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে তৈরী করেছেন প্রায় ৫ একর জমিতে বিরাট থাই পেয়ারা বাগান। যেখানে গ্রামের ২০জন হত দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
সম্প্রতি মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষ গুলোর ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দিতে, দারিদ্র্যতার সাথে যুদ্ধ করা সমাজের সুবিধা বঞ্চিত মানুষের মুখে হাঁসি ফোটাতে পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ্ মোঃ রফিকুল ইসলাম স্যারের একান্ত সহযোগিতায় চর কাজল ও চর বিশ্বাস ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান রুবেল মোল্লা ও মো.বাবুল মুন্সির সাথে সমন্বয় করে সুনামের সাথে সমাজ সেবা মূলক কাজ করে যাচ্ছেন।
সাব্বির আহম্মেদ নোবেল বেকারদের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমরা নিজেরাই জানো না তোমরা কত শক্তিশালী! তোমরা শুধু চাকরির পিছনে ঘুরছো! এটা এক ধরনের ফাঁদ! যতটুকু সময় তুমি চাকরির পিছনে ঘুরছো ওই সময়টুকু যদি নিজেকে উদ্ভাবনী ভাবনায় নিয়োজিত রাখতে তাহলে এমন অনেক আইডিয়া আছে যেগুলো ব্যবহার করে এত দিনে তোমরা সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারতে! সবথেকে জরুরী হচ্ছে নিজের প্রতি বিশ্বাস । প্রতিটা মানুষই স্বতন্ত্র এবং প্রতিটা মানুষই বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে দক্ষতা পোষণ করে। চাকরির চিন্তা না করে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হও এবং উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখো। ১০ বছর পর নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখো। স্বপ্ন দেখাটা জরুরি।
করোনার এই মহামারির সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেনো মানবিক কাজে নিজেকে উৎসর্গ করলেন ? এমন প্রশ্নের জবাবে নোবেল বলেন,
করোনা পরিস্থিতি শুরু হবার পর আমার মনে হয় সব মানুষের ভীষণ দম বন্ধ হয়ে আসছিল । একটা সম্পূর্ণ অজানা ভীতি সবাইকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। কিছুদিন আগে বাবাকে হারাই । আমার মানসিক অবস্থা ছিল আরো বেশি খারাপ অন্য সবার চেয়ে। খুব হতাশ ছিলাম । এরপরে যখন দেখলাম যে আমরা কেউই তো চাইলে ২০০ বছর বেঁচে থাকতে পারবো না, মৃত্যু একেবারে অবধারিত সত্য! তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, যতটুকু সময় বেঁচে থাকব নিজেকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত রাখবো। অনেক মানুষই পৃথিবীতে অনেক কিছু করে গেছেন । আমরা তো কিছুই করতে পারিনা। গ্রামের মানুষ একেবারেই অসচেতন। তাই সচেতনতার ভার নিজের কাঁধে তুলে নিলাম। এরমধ্যে লাইফ রিক্স ছিল শতভাগ। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রতিদিন শত শত মানুষ চলে এসেছে । তাদের বাড়ি বাড়ি যাওয়া, তাদেরকে প্রশাসনিক বার্তাগুলো পৌঁছে দেওয়া, সামাজিক নিরাপত্তা সম্বন্ধে বলা আসলে সহজ কাজ ছিল না। মাইলের পর মাইল আমাকে যেতে হয়েছে, কেউ পাগল বলেছে, কেউ বাজে মন্তব্য করেছে কোন কথাই আমি কান দেইনি । আমার কাছে মনে হয়েছে আমি যেটা করছি সেটাই সঠিক। এরপরে যখন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমাকে রাষ্ট্রীয় কল নাম্বার ট্রিপল ৩৩৩ এর জরুরী সহযোগিতার কাজ বুঝিয়ে দেন। আমি তখন এটা ভেবেছি যে, কাজ করে গেলে আরও কাজের সুযোগ তৈরি হয়। এর পরের বিষয়গুলো আপনারা জানেন।
এখন সামাজিক সেবামূলক কাজগুলোতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করি নিরপেক্ষতা বজায় রাখার এবং ন্যায় সিদ্ধান্ত দেয়ার। মানুষের অভাব মানুষের চাহিদা এবং মানবাধিকারের জায়গায় হাজারো সমস্যার মধ্যে যতটুকু আশ্বস্ত করা যায়, যতটুকু নিরূপণ করা যায় , যতোটুকু প্রতিকার করা যায় তা করব এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বাহিরে থেকেই সামাজিক দায়িত্বটুকু করে যাব। এই কাজ করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই আইনের প্রয়োগ এবং যৌক্তিক আচরণ করতে হয়। সে ক্ষেত্রে কোন গোষ্ঠী বা ব্যক্তি ক্ষিপ্ত হতে পারে, আঘাত পেতে পারে , স্বার্থের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যেতে পারে সে ক্ষেত্রে এটা বলবো, আমি গরিব-দুস্থ ও অনাহারীর পক্ষে । যাদের কেউ নেই তাদের পাশে আছি । রাজনৈতিক শক্তি, বংশ বা গোষ্ঠী শক্তির কাছে যে অতি সাধারণ মানুষগুলো ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন পায় না তাদের পাশে আছি। মানুষের ভালোবাসাই আমার সবথেকে বড় শক্তি। আমি কোনভাবেই ভীত নই, বিচলিত নই । ভাবনাটা যদি ন্যায় থাকে, ইচ্ছে যদি অটুট থাকে অবশ্যই আমরা আমাদের জীবনব্যাপী সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারি, জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে পারি, একটু ভালো থাকতে পারি, শুধু এই টুকুই!